ঘাসের জন্মকথা
প্রদীপ সেনগুপ্ত
শমিক
|
(গান) ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি, বনের পথে যেতে। ফুলের গন্ধে
চমক লেগে উঠেছে মন মেতে।
|
অন্তরা
|
থাক আর বেসুরো গলায় গাইতে হবেনা। এখন চল, নইলে একটা
চল্লিশের ক্লাস টা মিস করবি।
|
শমিক
|
ওটা তো প্যালিওন্টলজির ক্লাস। দূর, প্যালিওন্টলজি আমার
মোটেই ভালো লাগে না। অত ফসিলের নাম মনে রাখা যায় নাকি।
|
অন্তরা
|
ফসিলের নাম মনে রাখতে পারবিনা তো জিওলজি পড়তে এলি কেন?
ফিজিক্স নিয়ে পড়লেই পারতি।
|
শমিক
|
আমি ফিজিক্স পড়লে তুই আমাকে কথায় কথায় জ্ঞান দিতে পারতি?
|
অন্তরা
|
আমি ঠিক জ্ঞান দেওয়ার লোক খুঁজে নিতাম। আর তুই যা
ক্যাবলাকান্ত, তোরও একটা জ্ঞান দেওয়ার লোক ঠিক জুটে যেতো।
|
শমিক
|
বাজে কথা রাখ। দেখ এই
পার্কে কত ফুল ফুটেছে। ওগুলো চন্দ্রমল্লিকা নারে? আর শিমূল গাছটায় দেখ ফুল আসব
আসব করছে।
|
অন্তরা
|
তুই চন্দ্রমল্লিকা চিনিস?
|
শমিক
|
চন্দ্রমল্লিকা চিনবনা কেন? আমি অনেক রকম ফুল চিনি। গাছ
চিনি।
|
অন্তরা
|
এবার বলব, তোর বটানি পড়া উচিত ছিল।
|
শমিক
|
বটানি পড়লেও ত অনেক রকম ল্যাটিন নাম মুখস্ত করতে হত। সেটার
ঝকমারিও কম নয়।কিন্তু দেখ, জিওলজি পড়লে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, সবই অল্প
অল্প পড়া হচ্ছে। যাই বল জিওলজি বেশ মজার সাবজেক্ট।
|
অন্তরা
|
তুই এর মধ্যে মজাও পেয়ে গেছিস?
|
শমিক
|
মজা আছে। রোমান্স আছে।
|
অন্তরা
|
তোর মাথা আর মুন্ডু আছে।
|
শমিক
|
তোর মাথাটাও খারাপ, একবার আমাকে ফিজিক্স পড়তে বলছিস ,
আবার বলছিস বটানি পড়তে।
|
অন্তরা
|
ঠিক আছে, তুই জিওলজি পড়লেই বা কি, আর বটানি পড়লেই বা আমার
কি!
|
শমিক
|
ওভাবে দেখিস না। আমি কেন জিওলজি পড়তে এলাম তার ডেফিনিট
কারণ আছে।
|
অন্তরা
|
শুনি, কি তোর ডেফিনিট কারণ?
|
শমিক
|
প্রথম কারণ হল আমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে এই
পৃথিবীর সম্বন্ধে, মানে পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবর্তন সম্বন্ধে, যেটা জিওলজি পড়লেই
খানিকটা রপ্ত হয়।
|
অন্তরা
|
আর/
|
শমিক
|
আর, সারা জীবন ঘুরে বেড়ানোর জন্য জিওলজি নিয়ে কাজ করাই
সবচেয়ে ভালো। আমি বলি দি বেস্ট। আচ্ছা বল তুই মেয়ে হয়ে জিওলজি পড়তে এলি কেন?
|
অন্তরা
|
আমি কিছু ভেবে ঠিক আসিনি। মনে হয়েছিলো জিওলজি পড়লে ভাল
চাকরি হবে, তাই। কিন্তু এখন মনে হয় এসে ভাল করেছি।
|
শমিক
|
ভাল বলছিস কেন?
|
আন্তরা
|
এই তোর সাথে বন্ধুত্ব হল।
|
শমিক
|
ধ্যাৎ , এটা কোনো কারণ হল?
|
অন্তরা
|
কারণ হল না? বেশ বেশ, এখন ক্লাসে চল।
|
দৃশ্যান্তর
|
|
প্রফ রায়
|
আমি আজ তোমাদের প্যালিওজইক এরা নিয়ে বলব। এরা মানে জান ত?
মহাপর্ব। এই মহাপর্বের কয়েকটা ভাগ আছে। প্রথম ভাগ হল ক্যাম্ব্রিয়ান।
|
কল্যান
|
স্যার, প্যালিওজইক শুরু হচ্ছে ক্যাম্ব্রিয়ান থেকে। তা কত
বছর আগে থেকে?
|
শমিক
|
(ফিশ ফিশ করে) ওই তোর ছোট বেলা থেকে। তোর বয়স আর পৃথিবীর
বয়সের তো কোনো তফাৎ নেই।
|
কল্যান
|
দেখ, শমিক, ক্লাসের মধ্যে তোর ইয়ার্কি ভাল লাগেনা। তুই
নিজেও পড়বিনা, অন্যকেও পড়াশোনা করতে দিবিনা।
|
শমিক
|
আরে রাগ করিস কেন? স্যার কে আগে জিজ্ঞেস কর প্যালিওজোইক
মানে কি?
|
কল্যান
|
প্যালিওজোইক মানে আমি জানি। এর মানে হল পুরাজীবীয় পর্ব, এই
পর্বে প্রথম ডাঙ্গায় জীবের আবির্ভাব হল, আর
|
প্রফ রায়
|
তোমরা নিজেদের মধ্যে এত কথা বলছ কেন? আমি যা পড়াচ্ছি মন
দিয়ে শোনো। এই প্যালিওজোইক পর্বে প্রথম ডাঙ্গায় জীবের এবং উদ্ভিদের আবির্ভাব হয়।
এই উদ্ভিদের আবির্ভাবের সাথে সাথেই প্রায় সব ধরণের অমেরুদন্ডী প্রাণি এসে পড়ল
পৃথিবীতে।
|
শমিক
|
এসে পড়ল মানে
স্যার?
|
প্রফ রায়
|
আসলে আমি বলতে
চাইছি , ইভলভড হল বা বিবর্তণের মাধ্যমে উদ্ভুত হল।
|
শমিক
|
বুঝলাম, কিন্তু
মেরুদন্ডী প্রাণিরা এলো কবে?
|
প্রফ রায়
|
মেরুদন্ডী প্রাণিরাও এই প্যালিওজোইকেই এসেছে।
প্যালিওজইকের শেষ দিকে পৃথিবীতে রাজত্ব করা শুরু করল সরিসৃপরা, যারা ডাইনোসরের
পূর্বপুরুষ। কার্বনিফেরাস যুগে কিছু কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণি পৃথিবীতে দেখা গেল।
|
অন্তরা
|
স্যার, আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, মাছ তো এদের আগেই
এসেছে।
|
প্রফ রায়
|
তুমি ঠিক বলেছ।
মাছের মত প্রাণির আবির্ভাব প্যালিওজইকের শুরুর দিকে হয়েছিল। অরডোভিশিয়ান যুগে ৪৫
থেকে ৪৮ কোটি বছর আগে মাছের মত চেহারার প্রাণি এসেছিলো।
|
অন্তরা
|
আর গাছপালা কিরকম ছিলো?
|
প্রফ রায়
|
প্যালিওজইকের শুরুর দিকে ছিলো, মস বা শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ।
ক্রমে ক্রমে এদের রূপান্তর ঘটল। আরও জটিল ধরণের , যেমন ফার্ণ জাতীয় গাছের
আবির্ভাব হল। আর গন্ডয়ানা জুগে তো কথাই নেই।
|
শমিক
|
তার মানে?
|
প্রফ রায়
|
তোমরা গন্ডয়ানা যুগের কথা তো শুনেছ?
|
কল্যান
|
গন্ডোয়ানা যুগ মানে যে যুগে গন্ডয়ানা ল্যান্ড ছিল। ভারত
অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা সবাই এক সাথে জুড়ে ছিলো। আমি ঠিক বলছি স্যার?
|
প্রফ রায়
|
ঠিক বলছ বটে,
কিন্তু কোন সময়ে, কোন যুগে এরকম হয়েছিলো বলতে পারবে?
|
কল্যান
|
কেন। গণ্ডোয়ানা
যুগে!
|
প্রফ রায়
|
আরে বাবা ভূতাত্বিক টাইম স্কেলে, কোন সময়টাকে গণ্ডোয়ানা
কাল বলা হয়?
|
শমক
|
পারবনা স্যার।
|
কল্যান
|
কেন, স্কুলের ভূগোল বইতে পড়িসনি?
|
শমিক
|
পড়েছি বোধ হয়, কিন্তু কিছুই মনে নেই।
|
কল্যান
|
আমারও মনে নেই।
আপনিই বলে দিন স্যার।
|
প্রফ রায়
|
গন্ডোয়ানা যুগ না বলে একে মহাযুগ বলাই ভালো। শুরু
হয়েছিলো, কারবনিফেরাস যুগে। আজ থেকে পঁইত্রিশ কোটি বছর আগে। আর সেই যুগ চলল
একেবারে মেসোজোইকের শেষ পর্যন্ত। মানে আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পর্যন্ত।
|
শমিক
|
বুঝলি, এর মধ্যেই
এক ফাঁকে ডাইনোসরেরা এসে রাজত্ব করে চলে গেল।
|
কল্যান
|
তুই ডাইনোসরের
কথা হঠাৎ তুললি কেন?
|
প্রফ রায়
|
মনে হচ্ছে এক দিনেই তোমরা পুরো জিওলজি শেষ করে দেবে। একটু
চুপ করে বসো। আমি তোমাদের ক্যাম্ব্রিয়ান
প্যালিওন্টলজি নিয়ে নোট দিচ্ছি। সবাই লিখতে থাকো।
|
কল্যান
|
এক মিনিট স্যার, আমাদের এবার কোথায় ফিল্ডে নিয়ে যাবেন
স্যার?
|
প্রফ রায়
|
আমি ভাবছি, গন্ডোয়ানাল্যান্ড।
|
(দৃশ্যান্তরের সঙ্গীত)
|
|
প্রফ রায়
|
আমরা এই যেখানে এসেছি এটা একটা কোলিয়ারি এলাকা। এখান
থেকেই তোমাদের ফিল্ড শুরু হবে। এখানে তোমরা বেশ কয়েক ধরণের রক টাইপ দেখতে পাবে।
|
অন্তরা
|
স্যার, রক টাইপ মানে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা,
রুপান্তরীত শিলা সবই আছে এখানে?
|
প্রফ রায়
|
না সব নয়, তোমরা তো জানো, এই রানীগঞ্জ কোলফিল্ডে সবটাই
পাললিক শিলা, গন্ডোয়ানা যুগের। কিন্তু এর মধ্যে কোথাও কোথাও আগ্নেয় শিলা ঢুকে
রয়েছে। যাদের বলে ইন্ট্রুসিভ রক।
|
শমিক
|
পাললিক শিলার মধ্যে কি কি ধরণের শিলা আছে?
|
প্রফ রায়
|
আছে শেল মানে কাদাপাথর, কোল মানে কয়লা আর আছে
স্যান্ডস্টোন বা বেলে পাথর।
|
শমিক
|
স্যার, এত কয়লা এখানে আছে, তার মানে এখানে এক কালে বিশাল
অরণ্য ছিলো?
|
প্রফ রায়
|
ছিলোই তো, বিশাল গন্ডোয়ানা যুগের অরণ্য।
|
কল্যান
|
স্যার গন্ডোয়ানা তো প্যালিওজইকেরই একটা ভাগ তাই না?
|
প্রফ রায়
|
গন্ডোয়ানা যুগ মেসোজইক পর্যন্ত বিস্তৃত। লোয়ার গন্ডোয়ানা
হল প্যালিওজইকের ওপরের দিকটা, যাকে আপার প্যালিওজইক বলে। পারমিয়ান থেকে
কার্বনিফেরাস যুগ পর্যন্ত।
|
অন্তরা
|
কত বয়স হবে তার? মানে এই সব পাথরের?
|
প্রফ রায়
|
আজ থেকে ৩৫ কোটি বছর থেকে ২৮ কোটি বছর আগে পর্যন্ত।
|
অন্তরা
|
ওরে বাবা, তখন তো ডাইনসর আসেনি পৃথিবীতে। তাই না স্যার?
|
প্রফ রায়
|
ডাইনোসর এসেছে মেসোজইক যুগে... (পাথর ভাঙ্গার শব্দ)একি
তুমি এখনই পাথর ভাঙ্গতে শুরু করে দিলে?
|
শমিক
|
স্যার পাথরের মধ্যে একটা কিসের ছাপ রয়েছে স্যার, দেখুন
দেখুন।
|
প্রফ রায়
|
ওঃ তুমি ফসিল পেয়েছো?
|
শমিক
|
সত্যি স্যার! এগুলো ফসিল? কিন্তু কিসের ফসিল? দেখতে কোনো
প্রাণির হাড়ের মত লাগছে।
|
প্রফ রায়
|
না না ওগুলো হাড় নয়। ওগুলো এক ধরণের গাছের কান্ডের ছাপ।
নাম ভার্টিব্রেরিয়া। খুঁজলে আরও কয়েক ধরণের ফসিল এখানে পাবে।
|
শমিক
|
কয়েক ধরণ মানে স্যার?
|
প্রফ রায়
|
কয়েক ধরণ মানে, পাতার ছাপ পাবে, কান্ড পাবে, আর অণুবীক্ষণ
যন্ত্র দিয়ে দেখলে অনেক ধরণের স্পোর বা আণুবীক্ষনিক ফসিল দেখতে পাবে।
|
শমিক
|
আচ্ছা স্যার, ওই সময় তো অনেক ধরণের প্রাণি ছিলো। মাছ,
শামুক জাতীয় প্রাণি, পোকা, এসবের ফসিল পাব না?
|
প্রফ রায়
|
রানীগঞ্জ কোলফিল্ডে এরকম কোনও ফসিল পাওয়া যায়নি। এখানে যা
পাওয়া গিয়েছে সবই প্ল্যান্ট ফসিল মানে গাছপালার ফসিল।
|
শমিক
|
ফুল, মানে ফুলের ফসিল পাওয়া যায়নি?
|
অন্তরা
|
দেখ শমিক তুই ঠিক আলোচনাটা ফুলে নিয়ে এলি।
|
শমিক
|
দেখ, কান্ড আছে, পাতা আছে, স্পোর আছে, অথচ ফুলের ফসিল
নেই?
|
প্রফ রায়
|
আরে বাবা তখন ফুল থাকলে তো তুমি ফসিল পাবে!
|
ন্তরা
|
কেন? তখন গাছে ফুল হত না?
|
প্রফ রায়
|
না, কারণ তখন অন্য সব জীবের মত গাছপালারও আদিম অবস্থা।
নানা ধরণের ফার্ণ, কনিফার ইত্যাদি জাতের গাছই কেবল ছিল এই অরণ্যে।
|
অন্তরা
|
তা ফুল এলো কবে?
|
প্রফ রায়
|
ফুল এসেছে অনেক পরে। গন্ডোয়ানা যুগে সব গাছই ছিলো ব্যক্তবীজী
বা জিমনোস্পারম। এদের ফুল হতনা। কাজেই পরাগ দিয়ে এদের বংশ বিস্তার ঘটত না।
|
অন্তরা
|
ডিরেক্ট বীজ, ফল টল কিছুই হতনা?
|
প্রফ রায়
|
তোমরা নিশ্চয়ই পাইন জাতীয় গাছ দেখেছ। পাইনের যে ফল হয়
সেগুলো আসলে ফল নয়, বীজ। এর থেকে সরাসরি গাছ হয়। এই রকম আরও গাছ আছে, যেমন
লাইকোপোডিয়াম, ফার্ণ, এদের কোনও ফল বা ফুল হয় না।
|
অন্তরা
|
কিন্তু এক সময় তো পৃথিবীতে ফুলের গাছ ফলের গাছ এসব
জন্মালো, সেগুলো কবে এলো?
|
প্রফ রায়
|
আমরা ফুলের গাছের প্রথম ফসিল পাই ক্রিটেশিয়াস যুগে। মানে
সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেকার শিলায়।
|
শমিক
|
সেই পঞ্চাশ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে সাড়ে ছয় কোটি বছর
পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনও ফুলের গাছই ছিলনা? স্ট্রেঞ্জ! তার মানে এক লাফে ফুল হীন
গাছ থেকে ফুলে ভরা গাছ চলে এলো?
|
অন্তরা
|
সেই যে সহজপাঠে
পড়েছি না, কাল ছিলো ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে, বল দেখি তুই মালি হয় তা কেমন
করে?
|
শমিক
|
মাটির ভিতর দিয়ে করে ওরা যাওয়া আসা...।
|
অন্তরা
|
ঠিক বলেছিস! এরকম হতে পারে না। হঠাৎ লাফ দিয়ে কোনও কিছু
জন্মাতে পারে না। মাটির গভীরে নিশ্চয়ই কোথাও এর উত্তর আছে।
|
শমিক
|
মানে তুই বলছিস
ফসিল পাওয়া না গেলেও কোথাও না কোথাও এর উত্তর আছে।
|
অন্তরা
|
চল স্যার কেই
জিজ্ঞেস করি। দেখ এখানে আমরা কথা বলছি আর উনি কতটা এগিয়ে গিয়েছেন।
|
শমিক
|
ফিল্ডে স্যারের কোনও জুড়ি নেই। চল এগিয়ে চল।
|
প্রফ রায়
|
একি তোমরা অত পেছনে চলে গেলে কি করে। ভালো করে এই
স্যান্ডস্টোনগুল দেখ। এগুলো রানিগঞ্জ সিরিজের স্যান্ডস্টোন।
|
শমিক
|
স্যার, আমাদের একটা প্রশ্ন ছিল।
|
প্র রায়
|
কি প্রশ্ন শুনি।
|
অন্তরা
|
স্যার ফুলওয়ালা গাছের বিবর্তনের কোনও চিহ্নই কি পাওয়া
যায়ানি? হঠাৎ করে ফুল ফলে ভরা গাছ পৃথিবীতে চলে এল। এরকম হল কি করে?
|
প্রফ রায়
|
তুমি যে প্রশ্নটা করেছ তা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের অনেকদিন
ধরে ভাবিয়েছে। স্বয়ং ডারউইন সাহেবও এটাকে বলেছেন একটা প্রাকৃতিক রহস্য। কিন্তু
আজ এই রহস্যের উত্তর অনেকটাই পাওয়া গিয়েছে।
|
শমিক
|
কি করে পাওয়া গেল?
|
প্রফ রায়
|
এর মূলে আছে ঘাস।
|
অন্তরা
|
(তাচ্ছিল্যের স্বরে) ঘাস?
|
প্রফ রায়
|
ঘাস কে অত
হেলাফেলা কোরোনা। ঘাস খুব ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস।এই যে চারদিকে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি
দেখি এর জন্মও একদিনে হয়নি। ঘাসেরও একটা বিবর্তন হয়েছে। ঘাসও পৃথিবীতে আছে
বহুকাল। কিন্তু আমাদের কাছে তার প্রমাণ এতকাল ছিলনা।
|
শমিক
|
আমরা বলছি ফুলগাছের কথা আর আপনি স্যার নিয়ে এলেন ঘাস।
|
প্রফ রায়
|
কেন? ঘাস কি ফুলগাছ নয়। কাশফুলকে তুমি ফুল বলনা?
|
অন্তরা
|
না না, ঠিক ঠিক
ঘাসে তো ফুল হয়। অনেক রকমেরই ফুল হয়।
|
প্রফ রায়
|
তার চেয়েও বড় কথা ঘাস হচ্ছে গুপ্তাবীজী বা
অ্যাঞ্জিওস্পার্ম। এর বীজ দেখা যায়না। বীজের আধারের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।
|
শমিক
|
বেশ তার থেকে কি প্রমাণ হল, স্যার?
|
প্রফ রায়
|
প্রথম কথা হল ঘাস হল গুপ্তবীজী, এর ফুল হয়। এখন আমাকে
প্রমাণ করতে হবে ঘাস পৃথিবীতে ক্রিটেশিয়াসের অনেক আগেই এসেছে।
|
অন্তরা
|
ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। তার মানে ঘাসের ফসিল পাওয়া
গিয়েছে।
|
প্রফ রায়
|
না, সেভাবে দেখতে গেলে ঘাসের অত প্রাচীন ফসিল পাওয়া
যায়ানি। কিন্তু ঘাসের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে।
|
অন্তরা
|
এবার একটু বুঝিয়ে
বলুন স্যার।
|
প্রফ রায়
|
বলছি, আচ্ছা বলতো চন্দ্রগুপ্তের সাথে চানক্যের যখন দেখা
হয়েছিল তখন চানক্য কি করছিলেন?
|
অন্তরা
|
স্যার আপনি জিওলজি ছেড়ে ইতিহাস নিয়ে পড়লেন?
|
প্রফ রায়
|
আরে বলই না। বলতে
পারলে একটা মস্ত রহস্যের দরজা খুলে যাবে।
|
শমিক
|
আমি জানি কি
করছিলো চানক্য। রাগে তিনি কুশ গাছ ওপড়াচ্ছিলেন। কারণ কুশের ধারে তার পা কেটে
গিয়েছিল।
|
প্রফ রায়
|
ঠিক উত্তর দিয়েছ। এইখানেই রয়েছে সব রহস্যের চাবিকাঠি। কেন
কুশে পা কেটে গিয়েছিল? কারণ কুশের পাতার ধারগুলো ধারালো। কেন ধারালো? এর উত্তর
পেতে জিওলজির দরজায় দাঁড়াতে হয়।
|
অন্তরা
|
স্যার আপনি ঠিক যেন ডিটেকটিভ গল্প বলছেন।
|
প্রফ রায়
|
এটা ডিটেকটিভ গল্পের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। ঘাসের ধারগুলো
ধারালো হয়। তোমরা খেয়াল করলে দেখবে সব ঘাসই আল্পবিস্তর ধারালো। কিন্তু কেন? এর
কারণ হল ওই ধার জুড়ে সারি সারি বসানো আছে এক ধরণের পাথর।
|
শমিক
|
কি ধরণের পাথর?
|
প্রফ রায়
|
ওগুলিকে বলে ফাইটোলিথ বা গাছপাথর। এমনিতে খালি চোখে দেখা
যায়না। খুবই ক্ষুদ্র সিলিকার স্ফটিক বা কেলাস। মাইক্রোসকোপের নীচে দেখলে দেখা
যায় ওই ক্রিস্টালের নানা রকমের আকার।
|
অন্তরা
|
কি ধরণের আকার?
|
প্রফ রায়
|
সেটা নির্ভর করে কি ধরণের ঘাস তার ওপরে। এই ফাইটোলিথের
শেপ অনেক সময় ডাম্বেলের মত হয়, আবার চিরুনির মত দাঁত ওয়ালাও হয়।
|
অন্তরা
|
এই ফাইটোলিথের ফসিল পাওয়া গিয়েছে?
|
প্রফ রায়
|
এই একটা জায়গায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব রয়েছে। ঘাসের
আবির্ভাব যে মেসোজইক পর্বে হয়েছে তা ভারতীয় বিজ্ঞানী বন্দনা প্রসাদ এবং অশোক
সাহানী প্রমাণ করে দিলেন।
|
শমিক
|
এরা কিসের ওপর
গবেষণা করেছেন।
|
প্রফ রায়
|
এরা দুজনেই
লক্ষনৌ এর ইন্সটিটিউট অফ প্যালিওবোটানির গবেষক। এরা ভারাতীয় ডাইনোসর নিয়ে গবেষণা
করেছেন।
|
অন্তরা
|
ডাইনোসর মানেই তো মেসোজঈক পর্ব তাই না স্যার?
|
প্রফ রায়
|
ঠিক বলেছ। কিন্তু
প্রমাণটা কি হল? তারা ডাইনোসরের মলের ফসিল যাকে কপ্রোলাইট বলে তাকে
মাইক্রস্কোপের নীচে ফেলে পরীক্ষা করলেন।
|
শমিক
|
কপ্রোলাইট দেখে কী
বোঝা যায়?
|
প্রফ রায়
|
সাধারণভাবে কপ্রোলাইট দেখে প্রাণিটির অন্ত্রের গঠন বোঝা
যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপের নীচে ধরা পড়ল আর একটা বিষ্ময়কর ব্যাপার।
দেখা গেল কপ্রোলাইটের ভেতরে রয়েছে প্রচুর ফাইটোলিথ যা ঘাসে পাওয়া যায়।
|
শমিক
|
দারুন ব্যাপার তো! তার মানে ডাইনোসররা ঘাস খেত?
|
প্রফ রায়
|
এই কপ্রোলাইট থেকেই প্রমাণ হয়ে গেল, ঘাস এসেছে পৃথিবীতে
সেই মেসোজোইক পর্বে, যখন বিশালাকায় ডাইনোসরেরা রাজত্ব করত। আর একটা জিনিসও জানা
গেল সেই সাথে।
|
অন্তরা
|
কি জানা গেল
|
প্রফ রায়
|
জানা গেল, মেসোজোইকের শেষে যখন পৃথিবী জুড়ে এক মহাপ্রলয়
ঘটেছিলো তখন ধরার বুকের থেকে ডাইনোসর সহ বহু প্রাণি ও উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে
গিয়েছিলো, তখন কিন্তু এই ঘাস বেঁচেছিলো এবং তারপর পৃথিবী ঘাসে ভরে গিয়েছিলো।
|
শমিক
|
এক দিক দিয়ে বলতে গেলে আজকের দিনের গুপ্তবীজী উদ্ভিদের
মধ্যে ঘাস সবচেয়ে পুরোনো। মহাপ্রলয় পার হয়ে বেঁচে আছে। অমরও বলা যেতে পারে।
|
অন্তরা
|
সেই জন্যই বোধ হয় ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদের চল রয়েছে
আমাদের দেশে।
|
শমিক
|
ঠিক বলেছিস ওই দুটো জিনিসই তো ঘাস।
|