Thursday 17 October 2013

আমার মা

আমার মা মৈত্রেয়ী সেনগুপ্তা ১৯২০ সালের ১৪ই জানুয়ারী পৌষ সংক্রান্তির দিন জন্মগ্রহণ করেন। যতদূর জানি মার জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। মার শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে জলপাইগুড়িতে, কিছু সময় ঢাকায় এবং কোলকাতায়। মা ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে এগারজন ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ এবং বোনেদের মধ্যে মেজ। বড়বোন অকালে গত হওয়ায় মা কে বড়দিদির মত দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়েছে সারা জীবন। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়ার জন্য মার মধ্যে যে গুণটি প্রথম ও প্রধান হয়ে উঠেছিল তা হল অন্যের জন্য স্বার্থ ত্যাগ। প্রথমে ভাই বোন ও পরে সন্তান এবং পরিবারের জন্য ত্যাগ স্বীকার থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী ও সমাজের জন্য নিজের সমস্ত স্বার্থ মাকে বিসর্জন দিতে দেখেছি।
মার শৈশবে যে মানুষটি তাঁকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন তিনি হলেন মার ঠাকুমা সৌদামিনি রায়।  প্রগতিশীল, সমাজসেবী ও লেখিকা এই মহিলার প্রভাব মার সারা জীবনের কার্যকলাপের মধ্যে বার বার দেখা গিয়েছে। মা শেষ জীবনে নিজের স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন।
১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মার জীবন কেটেছে জলপাইগুড়িতে। সেখানে মা বড় হয়েছেন আদর্শবান, রুচিসম্পন্ন, দয়ালু বৈদ্য পরিবারে। এই পরিবারটি সে সময়ে জলপাইগুড়ি শহরের মধ্যে অগ্রগণ্য পরিবারগুলির অন্যতম ছিল। ১৯৩৫ সালে আমার দাদু কলকাতায় চলে আসেন এবং মার কলকাতার জীবন শুরু হয় ও বাইরের জগতের সাথে বিশেষ পরিচিতি ঘটে। ১৯৩৮ সালে প্রতাপাদিত্য রোডের একটি বাড়ি ভাড়া করে দাদু বাস করতে শুরু করেন। সেই সময় টালিগঞ্জের কৃত্তিবাস লেনে একটি পাঠাগার ছিল। সেই পাঠাগারের সূত্রে এবং শ্রীমতী বাদল রায় নামে একজন মার্কসবাদী মহিলার সংস্পর্শে এসে মা  আলোকসংঘ নামে সংগঠনের সাথে যুক্ত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার দাদুরা সবাই কিছু দিনের জন্য দিনাজপুরে চলে যান। আমরা মার কাছে গল্প শুনেছি সে সময়ে সারা রাত গরুর গাড়ি করে চূড়ামন যাওয়ার । দিনাজপুরে দু মাস থাকার পরে সবাই চলে যান ঢাকায়। সেখানে র‍্যাংকিন স্ট্রীটে একটা বাসা ভাড়া করে তারা থাকতে শুরু করেন। ১৯৪২ সালে আমার দাদুরা সবাই আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। মা আবার আলোক সংঘের সাথে কাজ শুরু করেন।
সেই সময় মার সাথে পরিচয় ঘটে মার্কসবাদী মহিলা কর্মী মনিকুন্তলা সেন, অনিলা দেবী, রেনু চক্রবর্তী, লতিকা সে, অপর্ণা সেন ইত্যাদি ব্যক্তিত্বের সাথে। এদের প্রেরণায় কলকাতায় ও অন্যত্র আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। মা সেই সংগঠনেরও সদস্য ছিলেন। বরিশালের আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলনে মা রেনু চক্রবর্তীর সাথে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় এই আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যরা রিলিফের কাজ করত। মা সেই সব কাজে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাথে যুক্ত অনেকেই তখন আলোকসংঘে আসতেন। তার মধ্যে মার পরচয় ঘটেছিল গণেশ ঘোষ ও কল্পনা দত্তর সাথে। এই সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের শেলাই শেখানোর উদ্যোগ নেয়। ভবানন্দ রোডের শেলাই কেন্দ্রের দায়িত্ব ছিল মার ওপর। এই সূত্রে মা যাঁদের সংস্পর্শে আসেন তাঁদের অন্যতম হলেন সুপ্রভা দেবী, সত্যজিৎ রায়ের মা। এই সব কাজের পাশাপাশি সংসারের বহু দায়িত্ব এমনকি ছোট ভাইবোনদের পালন করার দায়িত্বও মাকে পালন করতে হত।
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৬ তারিখে মার বিয়ে হয়। আমি এখানে মার স্মৃতি কথার থেকে একটু পাঠ করছি।
“ ২৭ তারিখে আমি অতীতের সব ছেড়ে, যাদের সুখ দুঃখের সঙ্গে আমি জড়িয়ে ছিলাম, মা বাবা কাকা কাকিমা পিশিমা ও ছোট ভাই বোন ও দাদাদের, বৌদিকে ছেড়ে অন্য পরিবারের সবাইকে  আপন করে নিতে। গুরুজনদের অনেক উপদেশ সঙ্গে নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলাম......। আমার পরিবার অনেক বড়, আমার শশুর বাড়ির পরিবার খুব ছোট। সবাই আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন।”
১৯৪৬ সালের ২১ ডিসেম্বর আমার জন্ম হয় কলকাতায়। আমার তিন মাস বয়সে মা আমাকে নিয়ে কারশিয়ং এ আসেন। তারপর ঘুমে নিজের সংসার শুরু করেন। এর দু বছর পরে আমার বোনের জন্ম হয়। কার্শিয়ং এ। এর কিছু আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বহু কমিউনিস্ট নেতা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান। তাদের কেউ কেউ, ঘুমে আমার মার কাছে আশ্রয় নেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন গণেশ ঘোষ।
সম্ভবতঃ এই কারণেই আমার সরকারি চাকুরে বাবাকে দার্জিলিং জেলা থেকে জলপাইগুড়িতে বদলি করা হয়। তখন আমার বয়স তিন, বোনের এক। 
জলপাইগুড়ির সেই ভাড়াবাড়িটা ছিল ছোট্ট এক কামরা। বহু দূরে কুয়ো। বাগান, ঢেঁকিঘর, সব বাড়িওলাদের। কিন্তু আমাদের সাথে তাদের যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তাতে আমরা তাদের আত্মীয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি। আমাদের দুই ভাই বোনের শৈশব শুরু সেখানে। এখানে এসেই মার প্রথম কাজ হল আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো। আমরা ভর্তি হলাম শিশুনিকেতনে। মা আমাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসার জন্য রিকশ ঠিক করে দিলেন। শ্রীমন্ত দা সেই রিকশ ওলার নাম। আমার ধারণা মফসসল শহরে মাসকাবারি ভাড়া রিকশয় ইস্কুলে বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার প্রচলন মা ই প্রথম করেছিলেন।
এর পরে মা পাড়ায় বিদ্যানিকেতন নামে একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে কিছুদিন পরে মা প্রধান শিক্ষিকার ভার গ্রহণ করেন। এই স্কুলটি ছিল পান্ডাপাড়ার সমস্ত শিশুদের প্রথম স্কুল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ার সকলের কাছে মা হয়ে উঠলেন বড়দিদিমনি। ১৯৫৩ সালে আমার ঠাকুমা মারা যান।
পান্ডাপাড়ার প্রথম বাড়িটা ছেড়ে শেষবাতির কাছে একটা বাড়িতে আমরা চলে এলাম সম্ভবতঃ ৫৪ সালে। সেটা ছিল একটা পুরো বাড়ি, উঠান ছিল, আম কাঠালের গাছও ছিল। মার উৎসাহে আমি ও আমার বোন গাছে চড়া শিখে ফেললাম। এই সময় আমার ঠাকুর্দা আমাদের কাছে থাকতে এলেন কার্শিয়াং ছেড়ে।
আমাদের শৈশবের শিক্ষার প্রতিটি ধাপে মার উপস্থিতি ছিল। সংসারের সমস্ত কাজের ফাঁকে মা আমাদের পড়াতেন। শুধু পড়াতেন না আমাদের মনের মধ্যে যাতে কাব্য ও সঙ্গীতের উপলব্ধি গড়ে ওঠে তার জন্যও নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল।  মা আমাদের সঞ্চয়িতার থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য আবৃত্তি করা শেখাতেন।
১৯৫৭ সালে মা বেসিক ট্রেনিং গ্রহণ করার জন্য বানীপুরে যান। সেই সময় আমরা কিছুদিন জলপাইগুড়িতে মা কে ছাড়াই দাদু আর বাবার হেফাজতে থাকলাম। সেই সময় আমরা কিছুদিন কলকাতায় আমাদের মামাবাড়িতেও ছিলাম।
বেসিক ট্রেনিং পাশ করে মা ফিরে এলেন জলপাইগুড়িতে। সাথে নিয়ে এলেন একটি চরকা। চরকাটাতে কি করে সুতো কাটতে হয় তা  মা  আমাদের শিখিয়েছিলেন। মার কাছেই এই সময় আমরা প্রথম তুলি ধরতে শিখি। কি করে আলপনা দিতে হয়। কি করে একটা ছবিতে রঙ করতে হয় তা মা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।
সারা দিন মা অক্লান্ত পরিশ্রম করতেনখুব ভোরে ঘুম ভাঙলে শুনতে পেতাম মার খড়মের শব্দ আর উঠোন ঝাড় দেওয়ার আওয়াজ। তারপর উনোন জ্বলত রান্না হত। এই সাথেই মা আমাদের ঘুম থেকে তুলে পড়াতেন। তারপর আমাদের স্কুলের জন্য তৈরি করতেন। এই সাথে দাদুর সব রকম সেবা করতেন মা। সব কাজ সেরে মা স্কুলে যেতেন।
মার হাতের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ছাপার হরফের মত। মার হাতের লেখা বাংলা ক্যলিগ্রাফির নিদর্শন হতে পারে।
সংসারের সব কাজের ফাঁকে মা সেলাই করতেন। আমার বোনের ফ্রক আমার জামা মা সেলাই করতেন। মা উলের সেলাইতেও পারদর্শী ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মা উলের সেলাই করে গিয়েছেন। মা গুজরাটি সূচের কাজ শিখেছিলেন সুপ্রভা দেবীর কাছে। সেই কাজ করা টেবিল ক্লথ, রুমাল আমার ধারণা আমাদের আত্মীয়, অনাত্মীয় অনেকেই উপহার হিসাবে মার কাছ থেকে পেয়েছেন।
আমদের দুই ভাইবোনকে সাঁতার শেখানোতেও মা খুব আগ্রহী ছিলেন। পাড়ায় পাশের বাড়িতে একটি পুকুরে মা আমাদের সাঁতার কাটতে পাঠাতেন। দাদু আমাদের সাঁতার কাটা পছন্দ করতেন না। তাই দাদুকে লুকিয়ে মা আমাদের পাঠাতেন।
মা যেমন আত্মীয় স্বজনের কাছে পপুলার ছিলেন তেমনই পাড়া প্রতিবেশীর কাছেও খুব প্রিয় ছিলেন। মার ছাত্রছাত্রীদের কাছে মা প্রভূত সম্মান পেয়েছেন। সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন অতি প্রিয় মৈত্রেয়ীদি। বাড়ির কাজের লোক, গরীব মানুষদের প্রতি মার অত্যন্ত মমত্ব বোধ ছিল। তাদের কি করে উন্নতি হবে তার চেষ্টা মা সব সময় করতেন। এই রকম অনেকেই মার আশ্রয়ে ও শিক্ষায় জীবনে সুখি হতে পেরেছে।
মা’রা অনেক ভাইবোন হওয়াতে আমরা অনেক মামাতো মাসতুতো ভাই বোন পেয়েছিলাম। মার সেই সব বোনপো বোনঝি ভাইপো ভাইঝি রা সকলেই মার খুব প্রিয়পাত্র ছিল। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েরাও মার স্নেহ থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হয় নি।  আমার ছোটদাদু থাকতেন জলপাইগুড়িতেই। তিনি মাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমরা নিয়মিত ছোটদাদুর বাড়ি যেতাম মার সাথে। সর্বত্র সকল আত্মীয়দের সাথেই মা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
বছরে একবার আমরা কলকাতায় আসতাম মামা বাড়িতে। অন্য ছুটিতে কার্শিয়াং যেতাম পিশিমার বাড়িতে। আমার দুই পিশিমা ও আমাদের পিশতুতো দিদিরা মা কে অত্যন্ত ভালো বাসতেন। মা তার এই দুই ভাগ্নীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
১৯৬০ সালে আমার দাদু অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময় মা কে দেখেছি দাদুর সেবা করতে। সে সময়ে শয্যাশায়ী দাদুকে খাওয়ানো, পরিস্কার করে দেওয়া ইত্যাদি সব রকমের সেবা মা একা হাতে করতেন। আমার বোন ও আমরাও সেই সাথে সাধ্যমত দাদুর সেবা করতাম। মা শিখিয়েছিলেন এই কর্তব্য।
১৯৬১ সালে দাদু মারা গেলেন। আমি আমার প্রিয় সাথিকে হারালাম। মা বাবা পিতৃহীন হলেন।
মা চাইতেন আমি খুব ভালো কলেজে পড়ে খুব বিদ্যান হই। তাই আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর আমাকে কলকাতায় পড়তে পাঠালেন। আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলাম। আমার পড়াশোনা নিয়ে মাকে অনেক দুঃখ পেতে হয়েছে। বস্তুতঃ সেই সময় থেকেই মার দুঃখের দিন শুরু। ১৯৬৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর আমার বাবা মারা গেলেন। মার ওপর এসে পড়ল আমাদের মানুষ করার ভার। বিপুল আর্থিক কষ্টের মধ্যে মা আমাদের মানুষ করে তোলার জন্য প্রাণপাত করতে লাগলেন। যা রোজগার ছিল সবটাই আমাদের পাঠাতেন পড়ার খরচ হিসাবে। নিজের দিন চালানোর জন্য টিউশনি করতেন।
১৯৬৮ সালে বন্যায় আমরা আবার কষ্টের মধ্যে পড়লাম। কিন্তু এই সব কষ্টের মধ্যেও মা ছিলেন অবিচল। আমাদের মানুষ করার জন্য। এর পরে আমার জন্য মাকে আরো দুঃখ পেতে হয়। সেটা আমার রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য।
১৯৭১ সালে আমার বোনের বিয়ে হয়। আমি অবশেষে এম এস সি পাশ করি। এবং আমার প্রথম ভাগ্নী ইন্টির জন্মের মধ্য দিয়ে মার জীবনে বহুকাল পরে কিছুটা আনন্দের স্বাদ এসে পড়ে।
এর পরে ত্রিশ বছর মার কেটেছে কখনো সুখে কখনো দুঃখে। ১৯৮৪ সালে আমি চাকুরি সূত্রে জলপাইগুড়িতে বদলি হই। মা আমার সাথে থাকতে শুরু করেন। আমার ছেলে মেয়ে ও আমার বোনের দুই মেয়ে আমার মায়ের বুকের পাঁজর ছিল। মা তাদের আদর আর আহ্লাদ দিয়েছেন নিজের সর্বস্ব উজার করে।
মার সারা জীবনের সাধ ছিল নিজের একটা বাড়ি। এই বাড়ি করার জন্য মা শিলিগুড়ির কাছে আমার নামে এক টুকরো জমি কেনেন। মা ১৯৮৮ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পরে মার সাধের বাড়িটি আমি তৈরি করি।  ১৯৯৮ সালে আমি স্থির করি কলকাতায় বদলি হয়ে যাব। মা চাইলেন নিজে স্বাধীনভাবে নিজের জায়গায় থাকতে। কলকাতার ইঁটকাঠের থেকে প্রকৃতির মাঝে নিজের ছোট্ট বাড়িতে মা থেকে যেতে চাইলেন। তাই মার সাথে আবার আমার বিচ্ছেদ।
আমার মার কাছে আত্মীয় অনাত্মীয় ভেদাভেদ ছিলনা। মা সেই গ্রামের মধ্যে অনাত্মীয়দের আপন করে নিয়ে বাস করতে শুরু করলেন। একা। সেখানে মা অচিরেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কারো দিদা, কারো মাসিমা হয়ে মা আর একটি নতুন পরিবার গড়ে তুললেন।
আমার ছোটমাসী শুক্লা মার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তিনিও মার বাড়ির কাছেই একটি বাড়ি বানিয়ে বাস করতে শুরু করেন। এছাড়া আমার বোনের দেওর কাজল কাছেই থাকত। আমার বোন কিছুদিন পরে কলকাতায় চলে আসে। কাজল এবং ছোটমাসী মার দেখাশোনা করতেন।
এই নতুন বাসায়, গ্রামের মধ্যে থেকেও মা শুরু করলেন সমাজের জন্য কিছু ভালো কাজ। প্রথমে গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করলেন, এবং কিছুদিন পরে একটি মহিলা ও তার শিশু কন্যাকে নিজের কাছে আশ্রয় দিলেনসেই বঞ্চিত শিশুটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দুরুহ ব্রত নিলেন আমাদের সকলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে। মেয়েটির বুদ্ধি কম থাকা সত্বেও বছরের পর বছর প্রচন্ড পরিশ্রম করে তাকে মাধ্যমিকের দোরগড়ায় পৌছে দিলেন। এ এক অসাধ্য সাধন। আমার অনুরোধে মা নিজের জীবন স্মৃতি লিখতে শুরু করেন। কিন্তু তা শেষ হয়নি।
দীর্ঘ জীবনে মা অনেক দুঃখও পেয়েছেন। ছোটো ভাই ও দুই ছোটো বোনকে হারাতে হয়েছে। আরো অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছেন।
মার জীবনের শেষ দুটি বছর আমার বোন ও ভগ্নিপতি মার কাছে থাকতে শুরু করে। মার স্বাস্থ্য ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছিল। প্রায়ই ডাইরিয়া ও ব্রঙ্কাইটিসে ভুগতেন। আমার বোন কাছে থাকাতে সেই সময়ে মা কিছুটা সেবা পেয়েছেন যদিও কারো কাছ থেকে সেবা নেওয়াতে মার ঘোরতর আপত্তি ছিল। পাছে সেবা নিতে হয় সেই জন্য নিজের শরীরের কষ্ট প্রকাশ করতেন না। অসুস্থ শরীর নিয়েও সংসারের কিছু কিছু কাজ করতেন এবং পালিতা নাতনিকে পড়াতেন। তখন মার বয়স নব্বই পার হয়েছে।
গত বছর থেকে মার স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি হতে থাকে। উত্তরবঙ্গের প্রবল শীতে মার খুব কষ্ট হত। তাই এই বছর ঠিক হয় শীতকালটা মা কলকাতায় এসে থাকবেন। ১১ই নভেম্বর আমি মা কে কলকাতায় নিয়ে আসি। কলকাতায় এসে মা মোটামুটি সুস্থ থাকলেও দু বার পড়ে গেলেনআঘাত পেলেন, যদিও হাড় ভাঙেনি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম মা ক্রমশঃ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। আমাকে বারবার বলতেন আমার সময় হয়ে গিয়েছে। এবার আমি যেতে চাই।
এই অসুস্থ অবস্থাতেও মার কর্মজীবনের পরসমাপ্তি ঘটেনি। এই অবস্থাতেও মা নাতনির মেয়ের জন্য উলের জামা, টুপি মোজা বুনেছেন। শ্যামলীর এক ছাত্রীকে একটি উলের টুপি বানিয়ে উপহার দিয়েছেন। সর্বপরি মার সেবা করত যে মেয়েটি তাকে উল বোনা শিখিয়েছেন মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে পর্যন্ত। মৃত্যুর দশ দিন আগে ডাক্তার আমাদের বলেছেন উনি আর বেশী দিন নেই।

মার মৃত্যু শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে কবে আমরা টের পাইনি। মাত্র দু দিন আগে অবস্থার খুব অবনতি ঘটায় ডাক্তারের পরামর্শে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২০১২ সালের ২ রা মার্চ সকাল ১১টা ৪৮ মিনিটে মার কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

1 comment:

  1. I am speechless Pradipda! Apnar ma sotti i ekjan asamanna mahila chilen. Take abong erokom sakol make amar pranam janai. Apnakeo asankho dhannobad eto sundorvabe ei smriti lekhar janne.

    ReplyDelete

AdSense