রবীন্দ্রনাথের সাথে
কুকুরের সম্পর্ক নিয়ে এই রচনার আপাত কোনো প্রাসঙ্গীকতা নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ এত
বিষয় নিয়ে লিখেছেন, তাঁর রচনায় কুকুররাই বা বাদ যাবে কেন? বাদ যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গল্পে উপন্যাসে সারমেয় জাতি উপস্থিত হয়েছে বিভিন্ন
পটভূমিকায়। রবীন্দ্রনাথের শিশুপাঠ্যেও যেমন কুকুরের কথা রয়েছে আবার গোরার মত
উপন্যাসেও বারবার কুকুরের উল্লেখ রয়েছে। রবীন্দ্র সাহিত্যে কুকুর এসেছে প্রধানতঃ চার
ভাবে। তা হলঃ
১) উপমা হিসাবে ২)
কাহিনির চরিত্র হিসাবে। ৩) পরিবেশ রচনার খাতিরে, ৪) এবং স্বমহিমায়।
উপমা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ কুকুরকে ব্যবহার করেছেন নিজের
বর্ণনায় অথবা কাহিনির চরিত্রের মুখ দিয়ে। যেমন
“কুকুর মনিবহারা যেমন
করুণ চোখে চায়
কালের যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“সুতোর থেকে কাপড় ।
ভাগ্যে তাঁর ভিক্ষার
ঝুলি অসীম
তাই মানুষ সন্ধান পায়
অসীম সম্পদের ।
নইলে দিন কাটত
কুকুর-বেড়ালের মতো ।
তোমরা কি বলো, সব
চেয়ে বড়ো সন্ন্যাসী ওই কুকুর-বেড়াল”।
গোরা কহিল, “কেন চাইব না? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে
না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে— ছেলেমানুষ ক্রমে
বুড়োমানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর-বিড়াল হয় না। (গোরা)
বিনোদবিহারী
-না —বিয়ের পর
থেকে দারিদ্র্য বলে একটা কদর্য মড়াখেকো শ্মশানের কুকুর জিব বের করে সর্বদা আমার চোখের সামনে ..( গোড়ায় গলদ - তৃতীয় অঙ্ক - দ্বিতীয়
দৃশ্য) , ৩৪
রবীন্দ্রনাথ রচনায় কোনো ব্যক্তির প্রতি
বিষোদ্গার করেননি ঠকই, কিন্তু কারও অন্যায়, বিশেষতঃ কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়
ভারত বা বাঙ্গালী জাতীর প্রতি অবমাননাকর কোনও রচনা প্রকাশ করলে তার প্রতিবাদ
রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই করেছেন। স্যার লেপেল
গ্রিফিনের লেখা বাঙ্গালী জাতীর প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রবন্ধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে
রবীন্দ্রনাথ খেঁকি কুকুরের তুলনা এনেছেন।
“কুকুর-সম্প্রদায়ের মধ্যে খেঁকি কুকুর বলিয়া
একটা বিশেষ জাত আছে, তাহাদের
খেঁই খেঁই আওয়াজের মধ্যে কোনোপ্রকার গাম্ভীর্য অথবা গৌরব নাই। কিন্তু সিংহের জাতে
খেঁকি সিংহ কখনো শুনা যায় নাই। সার লেপেল গ্রিফিন জুন মাসের ফর্ট্নাইট্লি রিভিয়ু
পত্রে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে-একটা প্রবন্ধ লিখিয়াছেন তাহার মধ্যে ভারি-একটা খেঁই
খেঁই আওয়াজ দিতেছে। ইহাতে লেখকের জাতি নিরূপণ করা কিছু কঠিন হইয়া পড়িয়াছে”।
কুকুর দীর্ঘকাল ধরে মানুষের সাথী। রবীন্দ্র সাহিত্যে মানুষ
ও কুকুরের এই সখ্যতা ধরা পড়েছে বহুবার।
অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গাঁয় কবিতাটা হয়তো সকলেরই মনে আছে।
সেখানে এই লাইনটি আছে, “আত্মীয় কেহ
নাই নিকট কি দূর, আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর”। এখানে কুকুর এসেছে দুটো কারণে একটা অন্তঃ মিলের
কারণে, নিকট কি দূরের সাথে, ভক্ত কুকুর
এনে মিলিয়েছেন। কিন্তু সেই সাথে অন্ধ কুঞ্জ বিহারির গল্পও বলা হয়ে গেল। কুকুর এসে
কুঞ্জবিহারির নিঃসঙ্গতা দূর করেছে।
জীবনস্মৃতির বিলাত পর্বে রবীন্দ্রনাথ একটি
পরিবারে কুকুরের অবস্থান ও তার ভুমিকা নিয়ে লিখেছেন, “বার্কার-জায়ার সান্ত্বনার সামগ্রী ছিল একটি কুকুর— কিন্তু স্ত্রীকে যখন বার্কার দণ্ড দিতে ইচ্ছা করিতেন তখন পীড়া দিতেন সেই
কুকুরকে। সুতরাং এই কুকুরকে অবলম্বন করিয়া মিসেস বার্কার আপনার বেদনার ক্ষেত্রকে
আরো খানিকটা বিস্তৃত করিয়া তুলিয়াছিলেন”। মানুষের সাথি ও
কাহিনির চরিত্র হিসাবে কুকুরের এই আগমন।
গোরা উপন্যাসের একটি চরিত্র সতীশ কুকুর প্রেমিক তাই এক
জায়গায় রবীন্দ্রনাথ কুকুরের প্রসঙ্গ এনেছেন এই ভাবে-
সতীশ হঠাৎ তাহাকে
জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা বিনয়বাবু, আপনার কুকুর
নেই?”
বিনয় হাসিয়া কহিল, “কুকুর?
না, কুকুর নেই।”
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন,
কুকুর রাখেন নি কেন?”
বিনয় কহিল, “কুকুরের
কথাটা কখনো মনে হয় নি।”
আরেক জায়গায় এই ঘটনাটি আছে-
এমন সময় সতীশ তাহার
অচিরজাত কুকুর-শাবকটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া উপস্থিত হইল।
হরিমোহিনী ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বাবা সতীশ, লক্ষ্মী বাপ আমার, ও-কুকুরটাকে নিয়ে যাও বাবা!”
সতীশ কহিল, “ও
কিছু করবে না মাসি! ও তোমার ঘরে যাবে না। তুমি ওকে একটু আদর করো, ও কিছু বলবে না।”
হরিমোহিনী সরিয়া গিয়া
কহিলেন,
“না বাবা, না, ওকে নিয়ে
যাও।”
তখন আনন্দময়ী
কুকুর-সুদ্ধ সতীশকে নিজের কাছে টানিয়া লইলেন। কুকুরকে কোলের উপর লইয়া সতীশকে জিজ্ঞাসা
করিলেন,
“তুমি সতীশ না? আমাদের বিনয়ের বন্ধু?”
দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্যে কুকুর চরিত্র
হিসাবেও উপস্থিত এবং তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। গোরা উপন্যাসের এই পর্বে কুকুর
আনন্দময়ী ও হরিমোহিনীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে।
রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত
চরিত্রগুলির মধ্যে কুকুরের প্রতি ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়েছে অনেক জায়গায়। অনেক
ক্ষেত্রেই কুকুর পারিবারিক সদস্যের রূপও পেয়েছে।যোগাযোগ গল্পে আমরা তারই আভাস পাই।
পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে।
বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নীচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল। কুমু খাটে এসে
বসতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে দু পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ
আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে। (যোগাযোগ)
ঝাঁকড়া-চুলে-দুই-চোখ-আচ্ছন্নপ্রায় ক্ষুদ্রকায়া
ট্যাবি-নামধারী কুকুর। সে একবার ঘ্রাণের দ্ববারা লাবণ্য ও সুরমার পরিচয় গ্রহণ করেছে। ... (শেষের কবিতা -১৫, ৬১)
শেষ সপ্তকের ৩২ নং কবিতায় রয়েছে এই লাইনটি” কুকুর ডেকে উঠল
অকারণে । নটার ঘণ্টা বাজল দেউড়িতে । ...” এখানে কুকুর এসেছে শুধুমাত্র পরিবেশ রচনার খাতিরে। তার আর কোনো
ভূমিকা নেই। চিত্রা কাব্যগ্রন্থে সিন্ধুপারে কবিতায় কুকুরের
দেখা পাই এইভাবেঃ-
“চিত্রা নির্জন পথ চিত্রিতবৎ , সাড়া নাই সারা দেশে
রাজার দুয়ারে
দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে ।
অফুরান পথ , অফুরান রাতি , অজানা নূতন ঠাঁই —
অপরূপ এক স্বপ্নসমান , ...”
রবীন্দ্র রচনায় কতবার যে কুকুর এসেছে তা গুনে
বলার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কুকুরকে কী চোখে দেখেছিলেন? সেকি শুধু ইতর
জন্তু হিসাবে? নীচের এই কবিতাটি পড়লে অন্ততঃ তাই মনে হয়।
লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে
কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে।
দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর
কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্ পামর?
গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ,
কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ।
সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে
ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে।
মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু,
বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।
কণিকা ১৮৯৯
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ
চিরকালই অনন্য। বার বার তাঁর উত্তরণ ঘটেছে। নিজের জীবন দর্শণ ক্রমশঃ উদ্ভাসিত
হয়েছে নব নব উপলব্ধিতে। আমরা তাঁর গানে কবিতায় তারই স্পর্শ পেয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথ
রোগশয্যায় কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, যা তাঁর জীবন দর্শণের ও মানব জীবনের উপলব্ধির
সার। কিন্তু তাও কোথাও কিছু বাকি থেকে গিয়েছিল। তাই কণিকা রচনার চল্লিশ বছর পরে
আরোগ্য কাব্য গ্রন্থে তিনি কুকুর নিয়ে চরম উপলব্ধি লিখে গিয়েছেন এই কবিতায়।
আরোগ্য১৯৪০
প্রত্যহ
প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে
যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার
করস্পর্শ দিয়ে ।
এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি
সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ ।
বাক্যহীন প্রাণীলোক-মাঝে
এই জীব শুধু
ভালো মন্দ সব ভেদ করি
দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে ;
দেখেছে আনন্দে যারে প্রাণ দেওয়া যায়
যারে ঢেলে দেওয়া যায় অহেতুক প্রেম ,
অসীম চৈতন্যলোকে
পথ দেখাইয়া দেয় যাহার চেতনা ।
দেখি যবে মূক হৃদয়ের
প্রাণপণ আত্মনিবেদন
আপনার দীনতা জানায়ে ,
ভাবিয়া না পাই ও যে কী মূল্য করেছে আবিষ্কার
আপন সহজ বোধে মানবস্বরূপে ;
ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা
বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না ,
আমারে বুঝায়ে দেয় সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয় ।
দারুণ রিসার্চ তো ! কুকুর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এত কিছু লিখেছেন আগে কখনো খেয়াল করিনি... :-)
ReplyDeleteআরোগ্য কাব্যের কবিতাটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। কুকুরকে কেউ কি আগে কখনও এভাবে দেখেছে? "আমারে বুঝায়ে দেয় সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়" ।
DeleteKhub bhalo lage apnar lekha gulo.
ReplyDeleteএকটা লেখায় রবীন্দ্রনাথ ও কুকুর নিয়ে কিছু কথােএনেছি। আপনার এই প্রবন্ধটি উপকারে এসেছে অনেক। রেফারেন্স দিতে চােই এখান থেকে। কিন্তু লেখকের নাম কোথাও দেখছি না।
ReplyDeleteআমার নাম প্রদীপ সেনগুপ্ত
Delete