মুক্তমেলা ছিল সৃষ্টিশীল কলকাতার এক অনন্য আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছিল এবং কিছুদিন পরে কিছু গুন্ডার হস্তক্ষেপে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতি শনিবার এক অমোঘ আকর্ষণে বিকেল বেলায় মুক্তমেলায় হাজির হতাম। গিয়ে দেখতাম
কোনো এক শিল্পী গাছের ডালে তাঁর নতুন শিল্পকর্মগুলি সাজাচ্ছেন। কেউ গান গাইছে,
কেউবা আবৃত্তি করছে। এদের মধ্যে যাঁরা একটু অন্যরকম তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি
তুষার রায়। তাঁকে ঘিরে থাকা শ্রোতাদের ভীড়ে মধ্যমণি হয়ে কবিতা বলছেন। এমন সময় হয়তো
কোনো মাউন্টেড পুলিশ একটু উঁকি দিয়েছে। কবি বলে উঠলেন:
“পুলিশ ওরে পুলিশ
হাতে কী তোর, কুলিশ?
কবির কাছে আসিস যদি
টুপিটা তোর খুলিস”
কেউ অনুরোধ করলেই ওনার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ব্যান্ডমাস্টার বলতে শুরু করে
দিতেন, তাঁর অসামান্য নিজস্ব ভঙ্গিতে:
“আমি অঙ্ক কষতে পারি ম্যাজিক
লুকিয়ে চক ও ডাস্টার
কেননা ভারী ধুন্ধুমার ট্রাম্পেটবাদক
ব্যান্ডমাস্টার”
কবি তুষার রায় ছিলেন মুক্তমেলার
মুকুটহীন সম্রাট। তিনি যেখানেই দাঁড়াতেন তাকে ঘিরে একটা ভীড় জমে যেত। অসামান্য
বাচনভঙ্গী আর বেপরোয়া ভাষার জন্য।
পরবর্তিকালে চৌরঙ্গীর এক চায়ের দোকানে তাঁর সাথে আড্ডা দিয়েছি। সে অন্য এক
গল্প।
একজনের কথা মনে আছে, নাম মনে নেই। তিনি
না দেখে বাংলা ভাষার এক দীর্ঘ কবিতা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের লেখা মধুবংশীগলি
অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন।
একটু সন্ধ্যার দিকে আসতেন ডাক্তারবাবু।
তিনি আসতেন ধান্যকুড়িয়া থেকে। এসেই মাটিতে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতেন:
“ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায় সকাল ছটায়
গাড়ি
নিতুই ছোটা ছুটি কারণ স্টেশনের কাছে বাড়ি
আমি ডেইলি প্যাসেঞ্জার...”
গান শেষ হতেই সবাই আরো গান শুনতে চাইতো। তখন হয়তো “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে”
এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে গেয়ে উঠতেন:
“মোর প্রেয়সীর মান হইয়েছে, গুমরে কেঁদে মোলো
ওই কাঁদুনি গিন্নী তোমার বন্ধ করাই ভালো”
ডাক্তারবাবুর নাম যশোদাদুলাল মন্ডল। পুরোনো কলকাতার গল্পে এঁর একটা স্থায়ী আসন
থাকা উচিত। কারণ কলকাতার এক মর্মস্পর্শী অধ্যায় তাঁর গানে ধরা আছে। অদ্ভুত এক
ছন্দে গাওয়া গানটি হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে বেরিয়েছিল এবং অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।
শুনেছি ওটি নাকি প্ল্যাটিনাম ডিস্কও হয়েছিলো। গানটি হল:
“ক্যালকাটা নাইনটিন ফর্টিথ্রি অক্টোবর.......”
বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের মন্বন্তর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কলকাতার দৃশ্য
আঁকা আছে সেই গানে। কারো কি মনে পড়ছে সেই গানটা?
No comments:
Post a Comment