Thursday 31 December 2020

পোষাক ও ধর্ম

 

এটা সর্বৈব সত্যি ঘটনা। আমার বড়পিসিমার মুখে শোনা।
১৯৪৭ সাল। আমার বড় পিসেমশাই তখন পূর্ববঙ্গে একটা রেল স্টেশনে পোস্টেড। পিসেমশাই রেলের ডাক্তার ছিলেন। ক্যাম্বেল থেকে এলেমেফ পাশ করে রেলের চাকরীতে যোগ দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের যে স্টেশনে ছিলেন ভারত ভাগের দাঙ্গার আঁচ সেখানেও পড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগেও কিছু লোক তাদেরকে দেশ ছাড়তে বলে গিয়েছে। ডাক্তার বলে তখন পর্যন্ত গায়ে হাত পড়েনি। কিন্তু বেশিদিন থাকা যাবেনা সেটা পিশেমশাই বুঝে গিয়েছেন। পিশেমশাইও ঠিক করলেন কলকাতায় চলে যাবেন। যেতে হলে ট্রেনে যেতে হবে, পথে জায়গায় জায়গায় দাঙ্গা হচ্ছে।
যদি কোনো বিপদ হয় সেই ভেবে একটা প্ল্যান আঁটলেন। ঠিক করলেন মুসলমানের ছদ্মবেশে এখান থেকে যাবেন। সেই ভেবে দাড়ি রাখলেন, জলকে পানি বলা শুরু করলেন। চেক চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী কিনে আনলেন। পিসিমাও সিঁদুর মুছে হাতের নোয়া শাখা খুলে কাঁচের চুড়ি পরে নিলেন। মুসলমান মেয়েদের মত ঘোমটা দেওয়া অভ্যাস করলেন। কয়েকদিন পর আয়নায় নিজেদের চেহার দেখে বুঝলেন ছদ্মবেশ সম্পূর্ণ।
একদিন শুভক্ষণ দেখে শিয়ালদাগামী ট্রেনে উঠে বসলেন দুজনে। তাদের দেখে আর হিন্দু বলে বোঝার উপায় নেই। ট্রেনে বিশেষ ভীড় ছিলনা। বর্ডার পার হতেই দেখলেন ট্রেনের কামরায় তারা দুজন বাদে আর যাত্রী নেই। ট্রেন একসময় সন্ধ্যা নাগাদ শিয়ালদা স্টেশনে এসে ঢুকল। পিশেমশাই ভেবেছিলেন একবার হিন্দুস্থানে ঢুকে পড়তে পারলে আর পায় কে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল অন্য রকম। শিয়ালদা স্টেশনে তখন উদ্বাস্তুদের ভীড়। তারা যত্র তত্র ছড়িয়ে বসে আছে। পিসিমা পিশেমশাই নামতেই তারা ঘিরে ধরে কীল, চড় ঘুষি মারতে শুরু করল। তারা পোষাক দেখে ভেবেছে এরা দুজন মুসলমান। পিসেমশাই ভেবেছিলেন একবার ইন্ডিয়ায় ঢুকতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু তার জন্য যে ছদ্মবেশ ছাড়তে হবে সে কথা মনেই আসেনি।
যাই হোক প্রচন্ড মার খেয়ে তারা যখন প্ল্যাটফর্মে লুটোপুটি খাচ্ছেন তখন রেলের এক ড্রাইভার তাদেরকে চিনতে পেরে জনতাকে থামায়। তারপর সবাই মিলে রেলের হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি করে দেয়। কুড়ি বাইশদিন হাসপাতালে কাটানোর পর পিশেমশাইয়ের একটা উপলব্ধি হয়েছিল। বলতেন, অত ধর্ম ধর্ম করিসনা। গায়ের এই পোষাকটাই হইল গিয়া ধর্ম। আর কিছু না।

Saturday 26 December 2020

 

বীজপত্র

(গল্প)

 সুমন ছোটবেলায় খুব ভালোবাসতো বীজের ভিতর থেকে ছোট্ট চারা বের হওয়া দেখতে। ছোলা বা মটরের বীজ থেকে যখন ছোট্ট অঙ্কুর মাথা তুলত ও অবাক হয়ে যেতো। প্রশ্ন করতো, এই ছোট্ট ছোলা থেকে অতবড় গাছ হবে? একটু বড় হয়র যখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ছে তখন বায়োলজি বই থেকে একটা কথা শিখেছিল, বীজপত্র। বীজ থেকে যখন অঙ্কুর বের হয় তখন প্রথমে সে শিকড় বার করে। সেই শিকড় যখন মাটির ভিতরে তার ভিত পেয়ে যায় তখনই বীজপত্র ফাঁক হয়ে ছোট্ট শিশু গাছ মাথা তোলে। শিকড় মাটি না পেলে ওই বীজপত্রের আড়ালেই ঘুমিয়ে থাকে গাছের ভবিষ্যৎ। অপর্ণা সুমনকে ছোটবেলায় শিখিয়েছিলো সেই বিখ্যাত কবিতা," ইন দা হার্ট অফ এ সিড, বারিড ডিপ সো ডিপ এ ডিয়ার লিটল প্ল্যান্ট লে ফাস্ট অ্যাস্লিপ....।" সুমন বাগানে কোনও গাছের অঙ্কুর বের হতে দেখলেই কবিতাটা আবৃত্তি করত। সুমন তখন খুব ছোট ছিল। সুমন এখন অনেক বড় কলেজে পড়ে।

 অপর্ণা বাড়ি ছিলোনা। কিছু দূরে এক ছাত্রীর বাড়িতে গান শেখাতে গিয়েছিলো। নতুন পাড়ায় আসার পর বেশ কয়েকজন ছাত্রী জুটে গিয়েছে। সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীতই শেখে। অপর্ণার ক্লাসিকাল গানের ভিত তত জোরদার নয়। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত সে শিখেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত সে জানে। দীর্ঘদিনের সাধনায় নিজের জন্য এই একটা জায়গা সে করে নিতে পেরেছে। এই জানাটা অবশ্যই ঘটেছে গুরুর কৃপায়। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। যখন ছোট ছিল তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ও গাইতে ভালোবাসত। তারপর নিতমিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নিয়েছে। আজ যখন সে গান গাইতে বসে প্রতিটি গানকেই নতুন করে আবিষ্কার করে। মনে হয়ে প্রতিটি রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন প্রতিদিন নতুন করে লেখা হচ্ছে তার জন্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত অপর্ণার প্রতিদিনের বেঁচে থাকার রসদ নিয়ে আসে পরিপূর্ণভাবে।

 অপর্ণা বাড়ি ফিরে দেখল সুমনের ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। গীটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাইছে কোনো এক রক ব্যান্ডের ইংরাজি গান। এসব গানের সাথে অপর্ণা এখনো সমঝোতা করে উঠতে পারেনি। গানের কথা ও সুর সময় সময় অসহ্য মনে হয়। কী করে যে ছেলেটা এসবের ভক্ত হল। অথচ ছোটবেলায় অনেক যত্ন করে গান শেখানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে অন্ততঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত ওর হৃদয়ের গভীরে ঢুকে যাক। এ যে কি বিপুল সম্পদ আজ এই মধ্য বয়সে এসে অপর্ণ উপলব্ধি করতে পারছে। সেই উপলব্ধির কিছুটা অন্ততঃ ওর অন্তরেও ঘটুক। গলায় সুর আছে ছেলেটার। সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। খুব ছোটবেলায় যখন সরু গলায় গাইতো দূর দেশী কোন রাখাল ছেলে তখনই সুরে ভরে যেত চারধার। তারপর অপর্ণা কিছুদিন চেষ্টা করেছে কোনো বড় গায়কের কাছে গান শেখানোর। ল্কিন্তু দেখা গেল্ধারাবাহিকভাবে গান শিখতে তার ঘোরতর আপত্তি। বলে মা তোমার কাছে ছাড়া আর কারো কাছে গান শিখব না। কিন্তু তাই বা শিখল কই?

 কলেজে ঢুকেই কেমন যেন পালটে গেল ছেলেটা। বাংলা গান তো গাইতে বসেইনা, শুধু টিভি দেখে। সারাক্ষণ চ্যানেল ঘোরাচ্ছে আর আর এমটিভি বা ভিটিভ দেখছে। যখন টিভি দেখছেনা তখন দেখা যাচ্ছে কমপিউটার নিয়ে বসে ভিডিও গেম খেলছে। ওই সব বিদেশী গানে যে কী রস আছে অপর্ণার মাথায় ঢোকেনা। অপর্ণা আগে প্রতিবাদ করত, বলত, তুই তোর এত সুন্দর গলা নষ্ট করে ফেললি। আর এই সব গানের মধ্যে কী আছে? এগুলো কি  আমাদের গান?

 সুমন তেড়িয়া হয়ে জবাব দিতো, এগুলো তোমাদের গান নয়, আমাদের গান। আমাদের বয়সে এখন এসব গানই চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন অচল। বুড়োটে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেই মাথা ধরে যায়।

 অপর্ণা বলে কিন্তু এই গান আমাদের প্রাণের সম্পদ। আমাদের মনের সব কথা এতে রয়েছে। ইংরাজি গান ভালো লাগে বলে তুই আমাদের যেটা রুট, আমাদের শেকড়, সব ভুলে যাবি?

 এই রুট দিয়ে কী হবে? তোমরাই তো চাওনা আমরা রুট ধরে বসে থাকি। তুমি চাও আমি জি আরই দিয়ে আমারিকায় চলে যাই। সেখানে গেলে তোমার ওই রবীন্দ্রসঙ্গীত কে শুনবে বল? বাংলা গানের কোনো দাম নেই। আমরা যা শুনি তা গ্লোবাল সং।

 অপর্ণার মাথায় ঢোকেনা কেন সবকিছু পালটে গেল। এই ছেলেই এক সময়ে বায়না ধরে কঠিন কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে নিয়েছে তার কাছ থেকে। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত তখনই চাইতো ধ্রুপদ অঙ্গের গান তুলতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন রাগ চেনা হয়ে গিয়েছিল তার। তারপর যেদিন বয়ঃসন্ধিতে গলা ভাঙতে শুরু করল সেদিন কী দুঃখ। বার বার বলত, মা আমার গলা আর ঠিক হবেনা? আমি আর গান করতে পারবনা?

 অপর্ণা বলত কেন পারবিনা? সব ছেলেদেরই এই বয়সে গলা ভাঙে। দেখবি একটু বড় হলেই আবার গলায় সুর ফিরে আসবে। গান গাইতে পারছেনা দেখে অপর্ণা একটা গীটার কিনে দিয়েছিল। স্প্যানিশ গীটার। সুরের তীক্ষ্ণ বোধ থাকায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সেটা রপ্ত করে ফেলল। তারপর গলাও একদিন ঠিক হল। কিন্তু কী করে যেন ধীরে ধীরে গানের অভিমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে ঘুরে ইংরাজি পপ গানের দিকে চলে গেল।

 কথা বললেই আজকাল তর্ক শুরু হয়ে যায়। তাই অপর্ণা আর কিছু বলেনা। নিজে একা একাই গান গায়। গীতবিতানের পাতার ভিতরে আলাদা একটা মুক্তির জগত আছে তা সে প্রতিদিনই উপলব্ধি করে। আর মনে মনে হায় হায় করে, ছেলেটা এই সুধারসের থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছে।

 আজও সুমন ঘুম থেকে উঠেছে কিছুক্ষণ আগে। তারপরেই গীটার নিয়ে বসে গেছে। অপর্ণা জানে এখন কিছু বলেই লাভ নেই। যখন মনে হবে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে খেতে চাইবে। এখন মার সাথে এই একটাই সম্পর্ক রয়েছে। সকাল বেলাতেই এই বিদেশী সুরে গীটারের শব্দ অপর্ণা সহ্য করতে পারেনা। নিজের ঘরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নীল আকাশ, শীতে নিষ্পত্র একটা শিমুল গাছ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

 দুপুর বেলায় হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ওদিক থেকে নবনীতা ফোন করেছে, অপর্ণা, বৌদি এই একটু আগে হঠাৎ চলে গেলেন। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার এসেছিল, কিন্তু কিছুই করা গেলনা। আমরা সুবিনয়দার বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যাবে তো আমাদের বাড়ি চলে এসো এখনই।

বৌদি আর নেই ভাবতে ভীষণ কষ্ট হল অপর্ণার।  বলল, সুবিনয়দা তো এখন নার্সিং হোমে। বৌদির ওখান থেকে ফেরার পথে সুবিনয়দাকে একবার দেখে আসব।

 সুবিনয়দা চলে গেলেন ঠিক তিন দিন পরে। নার্সিং হোমেই। খবর পেয়েই অপর্ণা ছুটল। তখন দুপুর বেলা। সুমন কলেজ থেকে ফেরেনি। একটা চিরকুটে লিখল,  সুবিনয়দা মারা গেছেন। আমি যাচ্ছি। চাবি উপরতলায় রইল। খেয়ে নিও।

 সুবিনয়দার বাড়ি লোকের ভীড়ে অপর্ণা কাছে যেতেই পারলনা। কিছুক্ষণ আগেই শবদেহ নার্সিং হোম থেকে আনা হয়েছে। সাংবাদিক, সেলিব্রিটি, ভি আই পি দের ভীড়ে, ফুলের মালার স্তুপের ভিতর দিয়ে সুবিনয়দাকে আর দেখাই যাচ্ছেনা। অপর্ণার দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। সুবিনয়দা শুধু গুরু ছিলেননা, ওঁর কাছে বসে গান শেখা ছিল এক ঈশ্বরবন্দনার মত অনুভব। পঁচিশ বছর ধরে ওঁর কাছে গান শিখেছে। কত গান যে তিনি শিখিয়েছেন তার শেষ নেই। শেষের দিকে চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। কিন্তু তখন তাঁর গান যেন হয়ে উঠত কোন গভীর অন্তর থেকে উঠে আসা অমৃতবর্ষণের মত মধুময়। প্রতিটি ক্লাসেই উনি ওদের হাত ধরে স্বর্গের কাছাকাছি এক বাগানে পৌঁছে দিয়েছেন।

 সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যেই শবযাত্রার তোড়জোর শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশের পাইলট ভ্যান এসে গিয়েছে। কীভাবে কোন রাস্তায় সুবিনয়দাকে নিয়ে যাওয়া হবে তাই নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অফিসার কার সাথে যেন কথা বলছে। নবনীতা ধরা গলায় বলল, শোনো অপর্ণা আমরা কিন্তু রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত যাব। অপর্ণা উত্তর দিলনা। কোথায় যেন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় এই শূণ্যতা তা ঠিক ধরতে পারছেনা। এই শূণ্যতা কি গানের জগতে, নাকি তার মনের মধ্যে সেটাই  অপর্ণা খুঁজে বেড়াচ্ছিল।


সামনে হুটার লাগানো পুলিশের গাড়ি, তারপর সুবিনয়দার মরদেহ নিয়ে গাড়ি। তারপরেই নবনীতার ড্রাইভার কায়দা করে নিজের গাড়িটা মিছিলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। অপর্ণা তাকিয়ে দেখল কোন মন্ত্রবলে বাইপাসের সমস্ত গাড়ি স্তব্ধ অচল হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো লাল বাতি নেই। রাস্তাড় মোড়ে মড়ে পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি। পরমার মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে এগিয়ে চলল শবযাত্রা। পার্ক সার্কাসের মুখে সব গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সুবিনয়দাকে পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্যই।

পার্ক সার্কাস থেকে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত নতুন ফ্লাইওভারটা খুলে দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। অপর্ণা এখন পর্যন্ত ওটার উপর দিয়ে যায়নি। লম্বা সেতুটার উপরে আজ একটাও গাড়ি নেই। শূণ্যের মধ্যে লম্বা হয়ে সেতুটা শুয়ে আছে। খোলা রাস্তা পেয়ে পুলিশের গাড়ি আর সুবিনয়দার মরদেহ নিয়ে গাড়ীটা কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার অপর প্রান্তে অপর্ণার মনে হল, এটাই যেন সেই অনন্তের রাতা যে পথে চললে এক অবিনশ্বর আনন্দলোকে পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে হল, এই পথে সুবিনয়দাকে নিয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে শূণ্যে মিলিয়ে যাবে।

 রবীন্দ্রসদনে ভীড় উপচে পড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী এলেন ফুলের মালা নিয়ে। আরো কয়েকজন মন্ত্রী সরকারী আমলা এসে ফুলের মালা দিয়ে গেল। অপর্ণা আর নবনীতা কুন্ঠিত মুখে নন্দনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অপর্ণা নবনীতাকে বলল, আজ আর সুবিনয়দা আমাদের নন। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে। বাড়ি যাই।

 নবনীতা অপর্ণাকে কালীঘাট পার্কের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। একটু এগিয়ে রাসবিহারী মোড়ের কাছে অটো পেয়ে গেল অপর্ণা। সুবনয়দা যে আর বাঁচবেননা এবার নার্সিং হোমে যাওয়ার সময়ই সেটা বোঝা গিয়েছিল। এতবড় গায়ক, এতবড় একজন শিক্ষক চলে যাওয়া গানের জগতে এক বিরাট শূণ্যতা যে এনে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। ওঁর জায়গা আর কেউ নিতে পারবেনা। শেষ ক্লাসে সুবিনয়দা শিখিয়েছিলেন, অনন্তের বাণী তুমি বসন্তের মাধুরী উৎসবে। এই গানের কটা লাইন কেবল মাতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছেনা। অপর্ণার এই দুঃখের ভার নেওয়ার মত কেউ নেই বাড়িতে।

 অটো থেকে নেমে গলির মুখে দাঁড়িয়ে মনে হল, সুমন এতক্ষণে নিশ্চয়ই কলেজ থেকে ফিরেছে। একবার ভাবল, ওর জন্য কিছু খাবার কিনে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ভাবল, থাক, এই একটা দিন অন্ততঃ ও নিজের ব্যবস্থা করে নিক।

  বাড়ির কাছে এসে দরজায় বেল বাজাতে গিয়ে অপর্ণা থমকে দাঁড়ালো।। আজ ভিতর থেকে গীটারের আওয়াজ আসছেনা। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুমন একা গান গাইছে, আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো...। হাল্কা বাতাসে গাছের শাখার দোলনের মত গানের মীড়গুলো স্পষ্ট হয়ে বাজছে সুমনের গলায়।

 শ্যামলী দরজা না খুলে সিঁড়ির উপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। না শেকড় হারিয়ে যায়নি। মাটিতেই রয়েছে। বীজপত্র ফাঁক করে ধীরে ধীরে নতুন পাতা মাথা তুলছে।


 

আদম ইভের প্রত্যাবর্তন

(কল্পবিশ্ব ওয়েবজিনে প্রকাশিত )

অনীশবাবু প্রতিদিন সকাল বেলায় লেকে বেড়াতে যান। এটা অভ্যাস করেছেন শুধু শরীরচর্চার জন্যই নয়, ওখানে গেলে বেশ কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তারাও অনেকে তাঁরই বয়সী, সদ্য রিটেয়ার করেছে। দু একজন অল্প বয়সীও আছে। তারাও বেশ ভালো, খুব সম্মান দেয়। যেহেতু কলেজে পড়াতেন, অনেকেই তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করে। এই তো গত টিচার্স ডে তে একজন একটা ব্লু টুথ হেডফোন উপহার দিয়েছে। সেটা কানে দিয়ে মোবাইল থেকে গান শোনা যায়। অনীশবাবু আজকালকার টেকনোলজিতে ততটা অভ্যস্ত নন। নিজে কম্পিউটার চালাতে পারেননা। যা দরকার একমাত্র মেয়ে বসুধাই করে দেয়।

বছর দুয়েক হল নতুন একজন সদস্য জুটেছে। অবনী দত্ত। তিনি নাকি প্রবাসে ছিলেন। দুবছর হল  আলিপুরে বাড়ি কিনে সেখানে স্থিতু হয়েছেন। উনি রত্ন পাথরের ব্যবসা করে বহু টাকা উপার্জন করেছেন। ভদ্রলোককে দেখলে একটু অবাক লাগে। বয়স কত বোঝার উপায় নেই। উনি বলেন সত্তর বছর। কিন্তু এই বয়সে চামড়া ওরকম টানটান থাকে নাকি? বাংলা বলার সময় সম্পূর্ণ বাংলাই ব্যবহার করেন। একটু থেমে থেমে কথা বলেন, মনে হয় অনেক ভেবে কথা বলছেন। এই দুটি বিষয় ছাড়া আর সব ব্যপারেই স্বাভাবিক। নানা বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। কোনো সমসা হলে চট করে সমাধান বাৎলে দিতে পারেন। আলিপুরে বাড়ি কেনা সোজা কথা নয়। আর্থিক অবস্থা ভালো বলেই মনে হয়।

অবনী দত্তের ছেলের সাথেও আলাপ হয়েছে। বছর ত্রিশেক বয়স হবে। সুদর্শন চেহারা। নাম পৃথু, মহাভারতের একটি চরিত্রের নামে নাম। কথাবার্তায় চমৎকার। সে সকাল বেলায় লেকে দৌড়াতে আসে।  আধঘন্টার মত দৌড়ায়। তারপর সবার সাথে কুশল বিনিময় করে মেনকা সিনেমার উলটো দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। টানটান ঋজু চেহারা। অবনী দত্তকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন ছেলেটি একজন বিজ্ঞানী। তবে ঠিক কোথাও চাকরী করেনা। বাড়িতে নিজের গবেষণাগার আছে। ঘরে বসে বিভিন্ন সংস্থাকে বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ দেয়এর বেশি কিছু জানা যায়নি।

এই ছেলেটিকে দেখার পর থেকেই অনীশের মাথায় একটা নতুন ভাবনা এসেছে। পৃথুকে জামাই হিসাবে বসুধার সাথে ভালো মানাবে। কিন্তু জামাই করার ব্যাপারে কী করে যে কথাটা পারবেন এখনও ভেবে উঠতে পারেননি।

একদিন হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল। অবনীবাবু নিজে থেকেই অনীশবাবুকে নিমন্ত্রণ করলেন, এই রবিবার কী করছেন? আসুন না আমার বাড়িতে সবাই মিলে, একটু চা খাবেন, বিকেলে।

চমৎকার প্রস্তাব, অনীশবাবু লুফে নিলেন কথাটা, অবশ্যই যাব। বিকেল পাঁচটায় গেলে হবে? আমার স্ত্রী আবার ফেরেন ওই সময়, স্কুলে পড়ান কিনা।

বেশ তো স্ত্রী আর মেয়েকেও নিয়ে আসবেন সবাই মিলে গল্প করা যাবে। আপনার মেয়ে তো এবার ফিলোজফিতে এম এ পাশ করেছে, তাই না? এম ফিলে ভর্তি হয়েছে।

অনীশ একটু অবাক হলেন, এ কথাটা অবনী দত্তের জানার কথা নয়। হয়তো অন্য কারো কাছ থেকে জেনেছে। কিন্তু এম ফিলের কথাটা লেকের বন্ধুদের কাউকে বলেছেন বলে তো মনে পড়েনা।

আলিপুরে এমন একটা পুরোনো বাড়ি আছে তা অনীশের ধারণাই ছিলনা। বাড়িটা শুধু পুরোনো নয়, বাড়ির আসবাবগুলিও অন্য রকম। কোনো মিউজিয়ামে গেলে এরকম আসবাব দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ির মাঝখানে একটা চাতাল, তার চার দিক দিয়ে ঘর। দোতলা, বেশ চওড়া সিঁড়ি। অবনী বললেন, এটা একটা জমিদার বাড়ি। আমি কিনে নিয়েছি।

অবনীবাবুর ছেলের নাম পৃথু। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ছাদের উপরে চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে। দেখা গেল বাড়িতে আর কোনো কাজের লোক নেই। পৃথুই চা, খাবার সব নিয়ে আসছে। চমৎকার চা, খাবারও খুব ভালো। অনীশবাবুর মেয়ে বসুধার সাথেও পৃথুর আলাপ হল।  এক সময় দেখা গেল দুজনে আলাদা বসে গল্প করছে। অনীশবাবু লক্ষ্য করলেন ছাদের উপর অনেকগুলি নানা ধরণের অ্যান্টেনা।

পৃথু বলল, কাকু, আমার কাজটা একটু অন্য রকমের। আমি একজন অ্যাস্ট্রোবায়লজিস্ট। মহাকাশের অন্য গ্রহের প্রাণ নিয়ে গবেষণা করি। শুধু পৃথিবীতে নয় মহাশূন্যে আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে বুদ্ধিমান প্রাণি আছে। আমি মহাকাশের সেই সব গ্রহ থেকে আসা সঙ্কেত এখানে ধরি, সেগুলিকে বিশ্লেষণ করি। এটাই আমার কাজ। বিশ্বে আরো অনেক সংস্থা আছে যারা এই বিষয়ে গবেষণা করছে। আমি তাদের সাথে কাজ করি। গোপন কাজ, আশাকরি একথা আপনারা আর কাউকে জানাবেন না।

অনীশ বললেন, না না, আমি আর কাকে বলব? আমি সাহিত্যের মানুষ, এসব বুঝিনা।

পৃথু বলল, চলুন আমার কাজের ঘর আপনাকে দেখিয়ে আনি।

পৃথুর কাজের ঘর বলতে ঘর ভর্তি কয়েকটা কমপিউটার, দেয়াল জুড়ে অসংখ্য আলো আর বোতাম। বাড়ির ভিতরে এরকম একটা ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা দেখে অনীশ বেশ অবাক হলেন। বসুধাও বেশ অবাক হয়েছে। তার চোখে মুখে একটা সম্ভ্রমের ছাপ অনীশের দৃষ্টি এড়ালো না। পৃথু ছেলেটাকে তো ভালোই মনে হল। বসুধার সাথে বিয়ে হলে মন্দ হয় না। শুধু কী করে কথাটা পাড়বেন সেটাই সমস্যা।

কিন্তু তারও সমাধান হয়ে গেল। পৃথু একদিন নিজে থেকেই অনীশের কাছে প্রস্তাব দিল, আমি বসুধাকে বিয়ে করতে চাই। বসুধার এতে সম্মতি আছে।

বিয়েটা হল অবনীর বাড়িতেই। উনি বললেন এত বড় বাড়ি, খালি পড়ে রয়েছে। বিয়ে, বৌভাত দুটোই এখানে হোক।  ধুমধাম করে বিয়ে হলেও শুধুমাত্র একবস্ত্রে মেয়েকে সম্প্রদান করতে হল। শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নেওয়া পৃথুর পছন্দ নয়। অনীশের খুব ভালো লাগল সেটা। খুব ভালো জামাই পেয়েছেন।

বিয়ের দিন সাতেক পরে অনীশবাবুর মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। বসুধা ফোন করছেনা।  আজ তিন দিন হল একবারও ফোন করেনি। একটু চিন্তিত মনে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, বসুধার ফোন পেয়েছ?

অনীশের স্ত্রী বললেন, না তো! দিন তিনেক হল বসুধা ফোন করেনি। আমি ভাবলাম তোমাকে বুঝি ফোন করেছে। কী হল মেয়েটার, একদম খবর নেই।

এরকম হওয়ার কথা নয়। বিয়ের পর থেকে বসুধা প্রতিদিন ফোনে বাবা মার খবর নেয়। অনীশবাবু খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। বসুধাকে ফোন করলেন। ফোন থেকে যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো, এই নম্বর এখন উপলব্ধ নয়। বসুধার ফোন খারাপ ভেবে পৃথুকে ফোন করলেন। সেখান থেকেও একই কথা ভেসে এলো। অনীশ খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী হতে পারে? ওরা কি তবে বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে? গেলেও মা বাবাকে না জানিয়ে যাবে কেন?

অনীশবাবু বললেন, আজ বিকেলে চল ওদের বাড়ি যাই।

আলিপুরে অবনীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ি অন্ধকার। সদর দরজায় তালা ঝুলছে। অনীশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সবাই উধাও হয়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু না বলেই। তিন জনের এভাবে চলে যাওয়া মোটেই ভালো মনে হল না। একবার মনে হল মেয়ে দুষ্টু লোকের হাতে পড়েছে। যা দিনকাল, লোকের ব্যবহার দেখে মতলব বোঝার উপায় নেই। কিন্তু এত টাকা পয়সা যার সে তার মেয়েকে অপহরণ করবেই বা কেন? যে কারণেই হোক বিষয়টা গভীর দুশ্চিন্তার। এখন একমাত্র উপায় পুলিশের কাছে যাওয়া।

সব শুনে ওসি প্রথমে খুব ধমকালেন। আপনারা একেবারে খোঁজখবর না নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফ্রি লান্সার কনসালটিং বিজ্ঞানী। তার উপরে অন্য গ্রহের প্রাণি নিয়ে গবেষণা। এমন কথা কেউ শুনেছে কখনও। ছবি আছে?

অনীশ বিয়ের অ্যালবাম সাথে করেই এনেছেন। ওসি তার থেকে দুটো ছবি খুলে রেখে দিল। বলল, কাল সকালে সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে ওই বাড়ি সার্চ করতে যাব। আপনারাও সাথে যাবেন। এখন একটা মিসিং ডাইরি করে যান।

সারা রাত দুজনেই ঘুমাতে পারলেন না। মাঝে মাঝেই বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসছে। পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ ওসি এসে হাজির। চলুন আপনাদের ঐ বেয়াই অবনী বাবুর অনেক খবর পেয়েছি। দু বছর আগে সাড়ে দশ কোটি টাকায় ওরা বাড়িটা কেনে। এখানকার দুটো ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতেও বেশ কয়েক কোটি টাকা আছে। আপনার জামাইয়ের প্যান কার্ডও আছে। তবে জালও হতে পারেইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল হলে সবই সম্ভব। কিন্তু হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার মোটিভটা স্পষ্ট নয়।

তালা ভেঙে বাড়িটাতে ঢোকা হল। কিন্তু একেবারে ধোয়া পোঁছা। ওই বাড়িতে যে কেউ কোনোদিন বাস করেছে তার কোনো চিহ্ন নেই। পৃথুর ঘরের সব কমপিউটার, সুইচের প্যানেল সব উধাও। ছাদের অ্যান্টেনাগুলিও নেই। শুধু বাড়ির মাঝখানের চাতালে একটা বিশাল গর্তপ্রায় কুড়ি ফুট ব্যাস। গভীর প্রায় চল্লিশ ফুট। নীচে জল জমে আছে। পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে।

ওসি বললেন, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না বাড়ির মাঝখানে এত বড় একটা জলের কুয়ো। এরা তো দেখছি কোনো ক্লু রেখে যায়নি। ফরেনসিককে একবার খবর দিতে হবে। আর ওই গর্তটাও একটা রহস্য।

অনীশ বললেন, এই কুয়োটা তো আগে ছিলোনা।

ওসি শুনে বললেন মনে হয় কিছু দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। কুয়োর ভিতরে লোক নামিয়ে দেখা যাক। যদি ডেডবডি পাওয়া যায়।

লোক নামিয়েও কিছুই উদ্ধার হলনা। কয়েকটা ধাতুর টুকরো আর কিছু কলকব্জা পাওয়া গেল। দেখে মনে হয় গাড়ির পার্টস।  ধাতুর টুকরোগুলো নেড়েচেড়ে ওসি বললেন, এগুলি ফরেনসিকে পাঠাতে হবে।

আরো কয়েকদিন কেটে গেল। কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। মানুষগুলি যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন থানায় খবর করা হয়েছে। কেউ এদের দেখেনি। হাসপাতাল, স্টেশন, বিমান বন্দর কোথাও না।

দীর্ঘদিন ধরে লম্বা তদন্ত চলল। কিন্তু ফলাফল একেবারে শূন্য। পুলিশ হতাশ হয়ে দু বছর পরে ফাইল বন্ধ করে রেখে দিল।

অনীশবাবু এই ধাক্কায় অনেকটা ভেঙে পড়লেন। লেকে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়াও একরকম বন্ধ করে দিলেন। এর মধ্যে একদিন স্ত্রী ও মারা গেলেন। অনীশবাবু একেবারে একা হয়ে গেলেন।

এর প্রায় দশ বছর পরে একদিন বিকেল বেলায় শুনতে পেলেন বাইরে রাস্তার থেকে কে যেন তাকে ডাকছে অনীশ কাকু, অনীশ কাকু বলে। একটি মেয়ের কন্ঠস্বরজানলা দিয়ে দেখলেন একটি মেয়ে, বসুধার বন্ধু মন্দিরাহাতে একটা কাগজ। খুব উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলতে চাইছে। অনীশ তাকে উপরে আসতে বললেন।

মন্দিরারর মুখ চোখ উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে। হাতের কাগজটা অনীশের হাতে দিয়ে বলল, বসুধার একটা  ইমেইল পেয়েছি। আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা, কিন্তু আমার মেইলে পাঠিয়েছেআমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কী করে এলো তাও বুঝতে পারছিনা। আপনি পড়ে দেখুন। আমি প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছি।  সাথে একটা ছবিও আছে

বসুধা লিখেছে:

মা ও বাবা, আমি যে তোমাদের থেকে কত দূরে আছি তা মাইল, কিলোমিটার দিয়ে বোঝাতে পারব না। শুধু আলোকবর্ষ দিয়েই তা মাপা যায়। পৃথিবী থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে ঠিক পৃথিবীর মত একটা সবুজ নীল গ্রহে রয়েছি। এখানে বাড়ি ঘর শহর সব কিছু আছে, অনেক রকমের প্রাণি আছে, শুধু মানুষ নেইমানুষ বলতে আমরা তিনজন, যদি পৃথু আর তার বাবাকে মানুষ বলা যায়। ওরা এই গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণি। একেবারে মানুষের মত। ওদের সব কিছু, এমনকি ডিএনএর গঠন পর্যন্ত আমাদের মত। কিন্তু বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে মানুষের থেকে অনেক উন্নত। এরা বহু বছর আগে এখানে এক বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু হঠাৎ এদের মেয়েদের মধ্যে একটা জেনেটিক পরিবর্তন আসে। ফলে মেয়েরা আর সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আস্তে আস্তে এদের জনসংখ্যা কমে যেতে থাকে। অবশেষে তা শূন্যে নেমে যায়। তাই প্রায় তিন দশক আগে পৃথু আর তার বাবা মহাকাশে বেরিয়ে পড়ে যদি অন্য কোনো গ্রহে তাদের মত প্রাণি থাকে তবে তাদের কোনো নারীর  সাহায্যে তাদের হারিয়ে যাওয়া সমাজ নতুন করে তৈরি করতে পারবে।

অনেক নক্ষত্রলোক ঘুরে তারা পৃথিবীতে এসে মানুষের সন্ধান পায়। পৃথিবীর মানুষ সব দিক দিয়ে একেবারে তাদের মত। কলকাতায় বসে তারা খুঁজতে থাকে তাদের উপযুক্ত কনে।

তোমার মনে আছে সেই চায়ের নিমন্ত্রণের কথা। সেদিন ওরা চায়ের কাপে লেগে থাকা আমাদের লালা পরীক্ষা করে দেখেছিল আমাদের ম্যাচ হতে পারে কিনা। ওরা পৃথিবীর আরো অনেক মেয়েকে এই ভাবে পরীক্ষা করেছে। কিন্তু আমাকেই ওরা সবথেকে উপযুক্ত মনে করেছে।

বাড়ির মাঝখানে একটা গর্তে ওদের মহাকাশযান লুকানো থাকত। প্রথমে তাতে চড়ে আমরা চাঁদের কাছাকাছি এক বিশাল আন্তর্নক্ষত্র মহাকাশযানে আসি। তারপর চার বছর ধরে আলোর গতিতে যাত্রা করে এই গ্রহে এলাম।

ওদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে। আমাদের প্রথম সন্তানের ছবি পাঠালাম, ঋদ্ধি আমার কন্যা। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে জন্মেছে। পৃথু আর আমি এই গ্রহের নতুন আদম আর ইভ।

এখানে যান্ত্রিক ব্যবস্থা খুব উন্নতপৃথিবীর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থাও পৃথু করে দিয়েছে। আর তাইতো তোমাকে এই চিঠি পাঠাতে পারছি।

বাবা, তোমার থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে বসে তোমার মেয়ে একটা নতুন মানব সমাজের জন্ম দিচ্ছে। এতে তোমার গর্ব হবে না দুঃখ হবে, বুঝতে পারছিনা। চার বছর পরে তুমি এই চিঠি হাতে পাবে  পাবে কিনা তাও জানিনা।

ভালো থেকো বাবা, মা।                    

অনীশবাবু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। তারপর জামাকাপড় পরে তৈরি হলেন থানায় এই খবরটা জানানোর জন্য। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক পা নেমেই আবার উঠে এলেনথানায় জানিয়ে কী হবে? ওরা এসব কথা বিশ্বাসই করবে না।

মন্দিরার দিকে ফিরে বললেন, আমার জন্য একটা কম্পিটারের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস মা? আর ই মেইল করাটাও শিখিয়ে দিবি। এই চিঠির একটা উত্তর দিতে হবে।

(কল্পবিশ্বের লিঙ্কঃ আদম ইভের প্রত্যাবর্তন )

 

AdSense