Wednesday 2 July 2014

ডাকাতের গল্প

২০০২ সালের কথা। আমি তখন বাঁকুড়ায় পোস্টেড। বাঁকুড়া ডিভিশনের চার্জে। অফিসটা বড়ই। সরকারী বাড়ির চার তলায়।  অনেক দিনের অফিস। আমি এসেছি মাত্র একমাস হল।

সে সময় আমি ডেরা নিয়েছিলাম শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ভগবানপুর নামে একটা গ্রামে। সেখানে থাকার উদ্দেশ্য ছিল এই যে সেখানে আমার পরিচিত একটি এনজিওর ক্যাম্প অফিস ছিল। বেশ বড় একটা ঘর আমার জুটে গিয়েছিল। তা ছহাড়া বেশ খোলামেলা জায়গা। পিছন দিকে বেশ বড় বাগান, কুয়ো এসব রয়েছে। গরমের দিন বলে আমি উঠোনের মাঝখানে একটা পাতার ছাউনি বানিয়ে নিয়েছিলাম। মাথার উপর পাতার ছাউনি। চারদিক খোলা। ভগবানপুর থেকে বাসে করে রোজ যাতায়াত করতাম। মাঝে মাঝে অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফিরতাম। ভগবানপুরে কয়েকজন এনজিও কর্মচারী ছিল।  তাদের মধ্যে একজনের নাম সুনীল মাহাতো। বাড়ি পুরুলিয়া। খুব স্মার্ট আর রসিক।

আমার অফিসের বড়বাবুও খুব পুরোনো লোক। বহুদিন ধরে ডিপার্টমেন্টে আছেন। আমার সাথে চাকুরীর শুরু থেকেই পরিচয়। এই বড়বাবুর মেয়ের বিয়ে। দিনটা পড়েছে ৮ই মে। অর্থাৎ ২৫ শে বৈশাখ। বেশ গরম।  বিয়েতে যেতেই হবে।

যাই হোক বিয়ের দিন একটা গাড়ি করে বড়বাবুর বাড়িতে গেলাম। সাথে আমাদের অফিসের কেমিস্ট শ্যামল। শ্যামলের সাথে আমার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব বহুদিনের।  সেখানে গল্পগুজব করে খেয়েদেয়ে যখন উঠলাম তখন রাত এগারোটা। আর তখনই খেয়াল হল রাত্রে কোথায় গিয়ে থাকব। শ্যামল বলল চল প্রদীপদা একটা হোটেলে গিয়ে রাতাটা কাটিয়ে দিই।

সেই রাত্রে মনে হল বাঁকুড়ার সব মেয়ের বিয়ে এক দিনেই সা্রা হয়ে যাচ্ছে। সব কটা হোটেল বিয়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। একটাও জায়গা নেই। কি করা যায়। এত রাতে ভগবানপুরে ফেরাটা ঠিক হবে কিনা ভাবলাম। রাস্তাটা ভালো নয়, রাতের বেলায়। তার উপর বিয়ের তারিখ। এসব ভেবে ভাবলাম যাই অফিসেই গিয়ে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার অফিস সেই চারতলায়। কেয়ারটেকার চারতলার উপরে ছাদে গিয়ে শুয়ে ঘুম দিয়েছে। অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারলাম না।

অগত্যা ঠিক হল ভগবানপুরেই যাব। বাঁকুড়া শহর থেকে বেরিয়ে পুয়াবাগান পার হলে দুটো রাস্তা দুদিকে গিয়েছে। ডানদিকেরটা গিয়েছে পায়রাচালি হয়ে পুরুলিয়া। ভগবানপুর এই রাস্তাতেই পড়ে। আমরা পায়রাচালির রাস্তা ধরলাম। আমাদের সাথে রয়েছে ড্রাইভার আবদুল। খুব করিৎকর্মা ছেলে। ড্রাইভার হিসাবেও বেশ পটু।

তখন রাত প্রায় বারোটা। একেই গ্রাম দেশ। তার উপরে অত রাত। কাজেই চারদিক শুনশান। রাস্তায় আমরা আর আমাদের গাড়ি ছাড়া একটিও প্রাণি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কাশিবেদ্যা গ্রাম পার হলাম । এর পরের গ্রাম কালাপাত্থর।

কালা পাত্থরের পরে রাস্তায় একটা কালভার্ট পড়ে। তার কাছাকাছি যেতেই দেখি কালভার্ট জুড়ে কারা যেন রাস্তার পিলার ফেলে রেখেছে। রাস্তা বন্ধ। আমি নেমে  ওগুলো সরাতে যাব ভাবছি, এমন সময় আবদুল বলল, এক্ষুনি এখান থেকে পালিয়ে চলুন। ডাকাত আছে। আমি কিছু বলার আগেই আবদুল কি করে যেন গাড়িটা ঘুরিয়ে আবার বাঁকুড়ার দিকে দৌর লাগালো। আমাকে বলল পিছনে তাকিয়ে দেখুন। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি চার পাঁচজন লোক রাস্তার ধারের মাঠ থেকে উঠে আমাদের গাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।

আমরা আবার বাঁকুড়ার দিকে ফিরে চললাম। আজ রাতটা না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে দেখছি। এই সব বলতে বলতে যাচ্ছি। এমন সময় কাশীবেদ্যার কাছা কাছি দেখি দূর থেকে একটা হাড়ি আসছে। দুটো হেডলাইট জ্বলছে। আমি বললাম ওটাকে থামাতে হবে। কারণ ওখানে গেলে ওরা ডাকাতে হাতে পড়বে। আমি আবদুলকে বললাম, গাড়ি থামাও।

আবদুল রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেডলাইট ডিমারে দিয়ে দিল।  দূর থেকে গাড়িটা মিনিট খানেকের মধ্যেই কাছে এসে গেল। কাছে আসতে দেখি, গাড়ি নয়। দুটো মোটর সাইকেল। তাতে দুজন পাজামা পাঞ্জাবী পরা লোক বসে রয়েছে। আমাদের দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। আমি বললাম , আপনারা আর এগোবেন না। রাস্তায় ডাকাত আছে। কালভার্টের উপর পিলার ফেলে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে।

দুজনের মধ্যে একজন বলল, আপনারা কারা? আই আমার পরিচয় পত্র দেখালাম। বলয়াম আমাদের দুর্ভোগের কথা, একটু একটু। অদের মধ্যে একজন বলল, ভয় নেই আমরা কোতোয়ালি থানার লোক। উনি টাউন দারোগা। চলুন আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।

আমরা আবার গাড়ি ঘুরিয়ে ভগবানপুরের দিকে ফিরে চললাম। এবার একটূ অন্যরকম ব্যবস্থা। আমাদের সামনে দুজন পুলিশ মোটর বাইক নিয়ে আমাদের এসকর্ট করছে।  বেশ একটু গর্ববোধ হতে লাগল।

কালভার্টের সামনে এসে দেখি পিলারগুলো যেরকম ছিল সেরকমভাবেই পড়ে আছে। পুলিশ অফিসার দুজন বাইক থামিয়ে নেমে পিলারগুলো সরিয়ে দিয়ে আমাদের বলল, এবার আপনারা যান, আর কিছু হবেনা।

ভগবানপুর আমার ডেরায় এসে দেখলাম সুনীল মাহাতো জেগে বসে আছে। আমাদের দেখে একটু অবাক হল। বলল এত রাঁইতে?
আমি বললাম, জানো? আমাদের রাস্তায় ডাকাত ধরেছিল। তারপর তাকে আদ্যপান্ত সব বললাম
সুনীল শুনে বলল আমাকে আগে বুইলবেন তো স্যার ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? তোমাকে আগে বললে কি হত?
সে বল, আমি ভজাইঁন দিতাম।
এবার আমার অবাক হবার পালা। ভজাইঁন দিতাম মানে? সুনীল ডাকাতদের চেনে নাকি?
  এর উত্তরে সুনীল যা বলল তাহল, পুরুলিয়া বাঁকুড়া রুটে তাদের একটা বাস চলে। এই বাসে যাতে ডাকাতি না হয় তার জন্য কাশিবেদ্যার এক চায়ের দোকানে তারা প্রতিমাসে টাকা জমা দেয়।
 ওই চায়ের দোকানের মালিক আসলে একজন ছোট এজেন্ট। যারা ডাকাতি করে তারাও আসল ডাকাত নয়। আসল ডাকাত পর্দার আড়ালে থাকে। সিংহভাগ সেই নেয়। যারা ডাকাতি করে তাদের ভাগ্যে সামান্যই জোটে।
এর প্রমাণ পেলাম কয়েকদিন পরে।

আমাদের ক্যাম্পের কুয়োতে কয়েকদিন ধরে বিশেষ জল পাওয়া যাচ্ছে না। কুয়োটা আরো একটু গভীর করতে হবে। সুনীল খবর দেওয়ায় কয়েকজন মজুর সকালবেলায় এসে হাজির কুয়ো খুঁড়তে। সেদিন রবিবার। এমি একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি। সুনীল আমাকে ডাকল, স্যার আসেন একটু।

কুয়োর কাছে গিয়ে দেখি কতগুলি রোগা রোগা না খেতে পাওয়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে দুজনকে দেখিয়ে সুনীল বলল, সার কে দেইখে রাখ।
লোকগুলোর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শুকনো, রোগা, খেতে না পাওয়া দুজন হতদরিদ্র মানুষ। এরাই নাকি ডাকাত!
পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে এদের ডাকাতি করে যেতে হয় নিয়মিত। তারপরেও এরা দরিদ্রসীমার উপরে উঠতে পারেনা। ডাকাতি না করলে এরা বাঁচতে পারবেনা। ডাকাতি ছাড়লেই এদের পুলিশে ধরবে এবং বাকি জীবনটা জেলেই কাটাতে হবে।

No comments:

Post a Comment

AdSense