Sunday 20 July 2014

বাহির পথে বিবাগী হিয়া (রাজমহল)


আসুন দেখে যান, আনন্দবাজার পত্রিকায় পাকুড় থেকে লেখা এক ব্যক্তির চিঠি ছাপা হয়েছিল। তিনি লিখেছেন “এখানে দলদলি পাহাড়ের উপরে বিশাল বিশাল পাথরের কড়ি বর্গা ছড়ানো রায়েছে। কারা পাহাড়ের মাথায় এসব বয়ে নিয়ে এলো? যারা এনেছে তারা কি গ্রহান্তরের মানুষ?”
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, তখন দানিকেনের পপুলারিটির যুগ। দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ?, নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন, ইত্যাদি বইগুলো পড়ে মাথায় নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়। বন্ধু দিবাকর বলল, চল ঘুরে আসি।
চিঠিটার মধ্যে আরও অনেক কিছু লেখা ছিল। কিন্তু সেসব আর চোখে পড়েনি। শুধু স্টেশনের নাম বারহারোয়া আর দলদলি পাহাড়ের নাম মাথায় ছিল। একদিন জুন মাসে খুব ভোরে আমি আর দিবাকর নামলাম বারহারোয়া স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দলদলি পাহাড়ে যাব শুনে বলল উঠে আসুন।
বাস বারহারোয়া শহরের ভিতর দিয়ে চলল। পশ্চিমবঙ্গ বিহার (এখন ঝাড়খন্ড) সীমান্তে ছোট্ট শহর, তিন দিকে ঘেরা রাজমহলের পাহাড়। শহর ছাড়িয়ে একটু যেতেই দেখলাম লেখা রয়েছে “ ঘাট আরম্ভ”। ঘাট পেরিয়ে বাস যেখানে এলো তার চারদিক ঘিরে রয়েছে রাজমহলের ফ্ল্যাট টপ পাহাড়ের সারি এর নীচে একটা লতানো নদী, নাম গুমনি। গুমনি নদী রাজমহল পাহাড় থেকে বেরিয়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। গূমনি পার হয়ে কিছু দূর এগোতেই কন্ডাক্টার বলল দলদলি এসে গিয়েছে। আমরা নামালাম। সামনে প্রায় হাজার ফুট উঁচু পাহাড়।
পাহাড় দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রাস্তার ধার থেকে সটান উঠে গিয়েছে বেশ কয়েকশো ফুট। পাহাড়ের গোড়ায় ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রান্তর। বেশ কিছু দূরে একটা সাঁওতালি গ্রাম। একটা ছোট্ট রাস্তা গ্রামের ভিতর চলে গিয়েছে। গ্রাম পার হতেই দেখলাম পথ শেষ। শুধু মাঠ, বড় বড় কিছু গাছ আর ঝাঁটি বন।

বাংলো থেকে দলদলি পাহাড়

দলদলি পাহাড়ের গোড়া, এখান থেকেই ওঠা শুরু

 দিবাকর বলল, কোনখান দিয়ে উঠবি?    রাস্তা তো দেখছিনা।

বললাম, রাস্তার দরকার নেই, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যাব। ঠিক একটা পথ পেয়ে যাব।
তাই হল, কিছুটা উঠতেই দেখলাম পাহাড়ের গা বেয়ে একটা খুব শরু পথ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। কালো কালো পাথরের নুড়িতে ভরা সেই পথ। একজনের বেশি ওই পথ দিয়ে যেতে পারে না।
পাহাড়টা ন্যাড়া নয়। পুরোটাই প্রায় ঘাস আর ছোট গাছে ঢাকা। কিছু কিছু ফল গাছও রয়েছে। তার মধ্যে দেখলাম কদবেল আর আতা গাছ আছে। পাকা ফল দেখলাম না। পাহাড়ের মাথায় উঠতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল।
মাথায় উঠে দেখি নীচে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিছু দূরে বেশ বড় একটা গঞ্জ মতন রয়েছে। চারপাশে একই রকমের অনেক পাহাড় রয়েছে। পাহাড়গুলির মাথায় বর্ষার মেঘ জমে রয়েছে। আমি ভাবলাম বৃষ্টি হলে তো কোথাও আশ্রয় নেবার উপায় নাই। পাহাড়ের মাথাটা একদম সমতল। মাঠের মত
যাই হোক, যে জন্য আসা সেই পাথরের কড়ি বর্গা কোথায় রয়েছে খুঁজে দেখতে হবে। বেশি খুঁজতে হলনা। বড়বড় ঘাসে ঢাকা মাঠের মধ্যেই কয়েকটা বিশাল বড় পাথরের থাম পড়ে রয়েছে। এক একটা ছয় সাত ফুট লম্বা, আর ছয়কোনা। সব কটিই বেসাল্টের কলাম।
বেসাল্টের কলাম দেখে বিশেষ বিষ্মিত হলাম না। কারণ রাজমহলের প্রতিটি পাহাড় আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরি। আজ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে এখানে আগ্নেয় প্রবাহ ঘটেছিল। বারবার পরতে পরতে। বহু হাজার বছর ধরে। বেসাল্ট জমে যাওয়ার পরে যখন ঠান্ডা হয় তখন সংকুচিত হওয়ার কারণে তার মধ্যে ছয়কোনা ফাটল তৈরি হয়। এই ফাটলগুলি বেশ কিছু গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে সেগুলি যখন ভেঙ্গে যায় অনেকটা ছয়কোনা পাথরের পিলারের আকার নেয়। স্বাভাবিকভাবেই। এর পিছনে পৃথিবী বা গ্রহান্তরের মানুষের হাত নেই।
কিন্তু এই পাথরগুলো এই পাহাড়ের মাথায় এভাবে সাজিয়ে রাখল কারা? এর পিছনে তো মানুষের হাত রয়েছে। কারা এই ভারি পাথরের পিলারগুলি বয়ে আনল, আর কেনই বা আনল? এক জায়গাতেই এই রকম কয়েকটা পাথর দেখলাম। বাকি পাহাড়ের মাথায় কিছুই নেই। শুধু ঘাসবন আর ঝাঁটির ঝোপ। আমার মনে কিরকম যেন সন্দেহ দেখা দিল। এই পাথর যারা এনেছে তারা এখনকার আধুনিক মানুষ নয়। হয়তো এখানে বহু প্রাচীন মানুষের বাস ছিল।
 যাই হোক, পাহার তো দেখা হল। পাথরের কড়িবর্গারও সন্ধান পেলাম। এবার নামার পালা। পাহাড় থেকে নীচে তাকাতেই বুঝলাম যে পথে এসেছি সে পথে নামা সম্ভব নয়। নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরছে। ওঠার সময় উপরের দিকে তাকিয়ে উঠেছি, তাই উচ্চতার ব্যাপারটা টের পাইনি।
 দিবাকর বলল, চল, খুঁজে দেখি কোথাও নিশ্চয়ই ঝর্ণা আছে। সেখান দিয়ে নামা সহজ হবে। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর সত্যিই একটা ঝর্ণা পেলাম। বেশ একটা ভ্যালি মতন আছে। খাড়াইও বেশি নয়। নামা যাবে। তবে পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে হবে।
অরণ্যময় উপত্যকা

 নামার পথে দেখলাম চারপাশে নানা রকমের সুন্দর সুন্দর পাথর পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে অ্যাগেট। অ্যাগেটের ছড়াছড়ি, নানান সাইজের আর নানা রঙের। আর আছে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল। একটু খুঁজে বেশ কিছু অ্যামেথিস্টের ক্রিস্টালও পেলাম। কিন্তু পাথরের খাঁজ থেক একটা বড়সর পাথর তুলে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। একটা ফ্লিন্ট বা চকমকি পাথরের টুকরো। ফ্লিন্ট এখানে প্রচুর রয়েছে। সর্বত্র ফ্লিন্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু এটা একেবারে অন্যরকম। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই পাথরে মানুষে হাতের কারিকুরি রয়েছে। যাকে বলে আর্টিফ্যাক্ট। পাথরটাকে হাতে তুলে আমার আর সন্দেহ রইল  না যে এটা একটা হ্যান্ড এক্স বা হাত কুঠার। প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্র।


পাথরের অস্ত্রঃ বর্তমানে জলপাইগুড়ির সায়েন্স ক্লাবের সংগ্রহে আছে

চারদিক নির্জন বহু দূর পর্যন্ত লোকের বসতি দেখা যাচ্ছে না। আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেখানে একদিন প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষেরা এসেছিল। হয়তো শিকার করতে গিয়ে হাত থেকে খসে পড়েছিল এই পাথর। আজ এতকাল পরে সেটি আমার হাতে উঠে এসছে।
পাহার থেকে নামার পথে আর একটা ফ্লিন্টের টুকরো কুড়িয়ে নিলাম । এটা হাত কুঠার নয়, আকারেও ছোটো। কিন্তু পাতলা এই পাথরের ধারগুলি বেশ নিপুনতার সাথে ভেঙে ধারালো করা হয়েছে। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় দুপুর একটা। বেশ খিদে পেয়েছে। খেতে গেলে যেতে হবে পাহাড়ের মাথা থেকে যে গঞ্জটা দেখা যাচ্ছিল সেখানে।
গঞ্জ পর্যন্ত হেঁটে যেতে আরো এক ঘন্টা লাগল। গঞ্জটা বেশ বড়ই। নাম বারহেট। পাকুড় থেকে দুমকা যাওয়ার পথে পড়ে। এটা একটা ব্লক হেডকোয়াটার্সও বটে। থানা আছে। ভাষা মূলতঃ বাংলা চলে। সেই সময়টা বড় সুন্দর ছিল। মানুষের মনে ভয়, সন্দেহ এসব কম ছিল। সহজেই বেশ কিছু লোকের সাথে আলাপ হয়ে গেল। তাদের কাছে শুনলাম এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গুমনি নদী পার হয়ে গেলে একটা গুহা আছে। তার মাম শিবগদ্দি। লোকে সেখানে শিব পুজা করতে যায়। কথিত আছে গুহাটা নাকি সাহেবগঞ্জ পর্যন্ত ছিল। ইংরেজরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এই বারহেটে একটা পুকুর আছে, তার ধারে মাটিতে খুঁজলে পাথরের চাল, ডাল ইত্যাদি পাওয়া যায়।
পাথরের অস্ত্র সংগ্রহের জায়গা
 খাওয়াদাওয়ার পর পুকুরের ধারে গিয়ে মাটি খুঁড়ে কিছু পাথরের চাল আর ডাল সংগ্রহ করলাম। একজন আমাদের জানালো কোন এক সাধুর অভিশাপে নাকি এখানে সমস্ত খাদ্য শষ্য পাথর হয়ে গিয়েছে।
সেবার বারহেটে রাত্রিবাস করিনি। সে রাত্রেই কোলকাতা ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ পাথরে অস্ত্র আর চালডালের রহস্য মাথার মধ্যে ঘুরতেই থাকল কয়েকদিন ধরে। পাথরের অস্ত্রগুলি দেখালাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগে। তাঁরা ওগুলিকে প্রাচীন প্রস্তর যূগের অস্ত্র বলেই সনাক্ত করলেন। বললেন আমারা আগে নাকি আর কেঊ এটা সম্বন্ধে রিপোর্ট করেনি।
এক মাস পরে আবার গেলাম বারহেট। এবার একটু থাকার প্রস্তুতি নিয়ে। আমার সাথে এলো নৃতত্বের একজন গবেষক, সোমনাথ। আমরা ওখানে আরো কিছু প্রাচীন প্রস্তর যুগের সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পেলাম। প্রচুর অস্ত্রও সংগ্রহ করলাম।
এরও কয়েক বছর পরে আবার গেলাম সেখানে। তখন বারহেট অনেক বদলেছে। গুমনি নদীতে একটা বাঁধের নির্মানকার্য চলছে। একটা বাঙলোও হয়েছে, যেখানে রাত্রীবাস করা যায়। গুমনি পায়ে হেঁটে পেরিয়ে শিবগাড্ডি পাহাড়ে গেলাম। ভারি সুন্দর জায়গা। বিশাল বেসাল্টের ক্লিফের নীচে একটা গুহা। গুহার মাথার উপরে বেসাল্টের কলাম ঝুলছে। একটা মন্দির আছে। কিন্তু বিশেষ লোকজনের দেখা পেলামনা।
এর পরে আরো কয়েকবার সেখানে গিয়েছি। মূলতঃ কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল আর জিওড সংগ্রহ করার জন্য। অনেক বন্ধুদের সাথে নিয়ে গিয়েছি। সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল ওই নির্জন পরিবেশ।
সব শেষে গেলাম ২০০৬ এ। প্রথম দেখার প্রায় ত্রিশ বছর পরে। গিয়ে দেখলাম বারহেট থেকে শিবগাড্ডি পর্যন্ত পাকা রাস্তা হয়ে গিয়েছে। অটো চলে। যে প্রাকৃতিক নির্জনতা ছিল তা অন্তর্হিত। রাস্তার উপর এক বিশাল তোরণ বানানো হায়েছে শিবগাড্ডির যাত্রীদের আকর্ষন করার জন্য। শিবগাড্ডিতে স্কুল হয়েছে পান্থশালা হয়েছে। মোবাইল টাওয়ার বসেছে।  কিন্তু ধার্মিক মানুষেরা গুহার মুখটি গ্রিল আর লোহার দরজা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এই গুহা আগ্নেয় প্রবাহের ফল স্বরূপ প্রাকৃতিক কারণেই জন্মেছিল। লাভা প্রবাহের বাইরেটা জমে শক্ত হয়ে যাওয়ার পরে এই গুহামুখ দিয়ে ভিতরের তরল লাভা বেরিয়ে এসেছিল। হয়তো প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষেরা  এই গুহাতেই আশ্রয় নিত। 
 শিবগাদ্দি : বেসাল্টের গুহা

ধর্মের চাপে আমাদের প্রাগৈতিহাস আর প্রকৃতির ইতিহাস দুইই লুপ্ত হয়ে গেল। 
ইরিগেশন বাংলো
রাত্রে বাংলোতেই ছিলাম। বাংলোটা এখনও একই রকম রয়েছে। তবে খাওয়ার ঘরে ফ্রিজ বসেছে। শোয়ার ঘরে এসি রয়েছে। আমি চৌকিদারকে বললাম এসি চালিয়ে দিতে। তার উত্তরে সে বলল, এখানে সবই আছে, এসি ফ্রিজ, জলের পাম্প ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পঁচিশ বছরের মধ্যে এখানে বিদ্যুত আসেনি একবারও।



Tuesday 15 July 2014

বারদুয়ারীর রূপকথা

কালিমার্কার ইনসপিরেশন ঢেলে
কাঁচের গেলাস হাতে তুলেছেন কবি।
 কিছু দূরে তাঁর ঘন নীল ইন্ডিকা,
 নীল চশমায় যুবক বেলার ছবি।

তিরিশ বছর প্রবাসে কেটেছে দিন
 মুঠোর ভিতর মোলায়েম সাকসেস।
দেশে ফিরেছেন নস্টালজিয়া নিয়ে
 বারদুয়ারিতে খুঁজতে পুরোনো রেশ।

এই পথ থেকে অনেক অনেক শাখা
 কাউকে দিয়েছে ঠিকানা বিহীন ঘর
 কাউকে দিয়েছে সঙ্গিনী মদালসা
 সেই স্মৃতি নিয়ে ঠোঁট মোছে কবিবর।

এতকাল পরে সবকিছু ছায়াময়
কে জানে কোথায় পুরোনো সে বন্ধুরা,
কোন শাখাপথে কে গিয়েছে রসে মজে
 ফিরে আসবেকি সেই দিকভ্রান্তেরা?

বারদুয়ারীতে ছবি পাল্টায়নি কিছু
 পুরোনো সেলার, ফিরিওলা গাঁটকাটা,
উঠতি আঁতেল ব্যার্থ ডিরেক্টার
 তুফান উঠছে স্মৃতির অতল ঘোলে।

বারদুয়ারিতে আসন্ন সাঁঝবেলা
 তিরিশ বছর আগেও নামত সাঁঝ
 সাঁঝ নামতেই নতুন খোলস ফেলে
 আসর জমাতো পুরোনো সে কোলকাতা।

সেদিনো এমনি সন্ধ্যা বেলার হাওয়া
 আগুন ঝরাতো কলমের মুখ থেকে
 বিপ্লব, সেতো আসবেই ঠিক দিনে
 ক্ষমতা আসবে পাইপগানের থেকে।

তারপর থেকে কেটে গেল কত দিন
 বিপ্লব হল প্রেমিকা অধরা ধরা
 কলমের থেকে আগুন নিবিয়ে দিয়ে
শুরু হয়ে গেল গ্লোবাল পাঠক ধরা

একটু অদুরে দুখানা টেবিল ছেড়ে
চোখে পড়ে এক পুরোনো দিনের ছবি
 কাঁধে ঝোলা ব্যাগ পরণে ময়লা ধুতি
অনিমেষ নয়? বাহাত্তুরের কবি?

পায়ে পায়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায় কবি
 চিনলে কি ভাই? চিনলে কি কমরেড?
 আমি সেই কবি, মনে আছে ‘স্পন্দন’?
মনে আছে সেই বাড়িতে পুলিশ রে’ড?

মার্কিনি ঢঙে মধুমাখা কমরেড
 শুনে অনিমেষ ভাবে এলো কোন শালা?
 খোচর নয়তো! নাকি নব গবেষক?
 ভর সন্ধ্যায় এ আবার কোন জ্বালা!

কবির হৃদয়ে অভিমান জমে ওঠে।
পুরোনো বন্ধু, চিনতে কি পারলেনা?
মনে নেই সেই স্বজন হারানো রাত?
মনে নেই, সেই উন্মাদ বিভীষিকা?

মনে নেই সেই শত শত লাশ জমা
 দমদম আর বরানগরের পথে?
সেদিন থেকেই তুমি আমি পলাতক
 সেই শেষ দেখা বাহাত্তরের রাতে।

স্মৃতির খোঁচায় চোখ খোলে অনিমেষ
 বেড়ে জামা গায়ে, পরণে নতুন জিনস
চেনা মনে হয় নেশায় ঝাপসা লাগে
হাত তুলে বলে এসো এসো বস পাশে।

তুমি আমি কেন, সবাই পালিয়ে গেছে
 শরীরের থেকে পালিয়েছে যৌবন,
কবে পলাতকা প্রেমিকা সুরঞ্জনা!
 পালিয়ে গিয়েছে কাব্য পিয়াসী মন।

পালিয়ে গিয়েছে নতুন দিনের আলো
হৃদয়ের থেকে বিপ্লব পলাতক
 যেদিকে তাকাই বন্ধুর দেখা নাই
শুধু জমে আছে ব্যার্থ স্মৃতির স্টক।

সেটুকু ঢাকতে সন্ধ্যায় এসে বসি
 দুই তিন গ্লাসে সব ব্যাথা কর্পুর
 তুমি তো বন্ধু রয়েছ যে বেশ তাজা
 কাব্য বেচার রসে টই টুম্বুর।

আমাদের কবি তার পাশে গিয়ে বসে।
 আমারও বন্ধু বদলে গিয়েছে দিন
যারা পালিয়েছে তারা হারিয়েছে সব
 যারা মরে গেছে তারা শুধু অমলিন।

কবি বসে ভাবে এই চেকনাই ছাড়া
 আমার কিছু কি জমে আছে সঞ্চয়?
আকাশে এখনও বোমারু বিমান ওড়ে
বুকের ভিতর জমেছে মৃত্যুভয়।

কবিতা লিখেছে অধ্যাপনার ফাঁকে
কাব্যে এনেছে অশান্ত কোলকাতা
বাজারে খেয়েছে অভিজ্ঞতার শাঁস
পকেটে ঢুকেছে মুঠোভরা সফলতা।

কবিতার হাটে বেচেছে দুঃসময়
 বেচেছে দেশের অসহায় মুখগুলি
 কাব্য বেচতে জাগিয়েছে এতকাল
 মনের ভিতরে চোরাপথ, ঘুলঘুলি।

এখোনো মাটিতে ধেয়ে চলে বন্দুক
 এখোনো রক্তে ভেসে যায় টাইগ্রিস।
একটি দেশের যত রণহুঙ্কার
অন্য দেশকে কাঁদায় অহর্নিশ।
Ì
রাত হয়ে আসে, দুই বন্ধুর মুখে
 কথা নেই কিছু, বুকের ভিতরে ক্ষত
সেইখানে কিছু ছাই পড়ে আছে, আর
 স্মৃতি পড়ে আছে দুঃস্বপ্নের মত।।

Wednesday 2 July 2014

ডাকাতের গল্প

২০০২ সালের কথা। আমি তখন বাঁকুড়ায় পোস্টেড। বাঁকুড়া ডিভিশনের চার্জে। অফিসটা বড়ই। সরকারী বাড়ির চার তলায়।  অনেক দিনের অফিস। আমি এসেছি মাত্র একমাস হল।

সে সময় আমি ডেরা নিয়েছিলাম শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ভগবানপুর নামে একটা গ্রামে। সেখানে থাকার উদ্দেশ্য ছিল এই যে সেখানে আমার পরিচিত একটি এনজিওর ক্যাম্প অফিস ছিল। বেশ বড় একটা ঘর আমার জুটে গিয়েছিল। তা ছহাড়া বেশ খোলামেলা জায়গা। পিছন দিকে বেশ বড় বাগান, কুয়ো এসব রয়েছে। গরমের দিন বলে আমি উঠোনের মাঝখানে একটা পাতার ছাউনি বানিয়ে নিয়েছিলাম। মাথার উপর পাতার ছাউনি। চারদিক খোলা। ভগবানপুর থেকে বাসে করে রোজ যাতায়াত করতাম। মাঝে মাঝে অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফিরতাম। ভগবানপুরে কয়েকজন এনজিও কর্মচারী ছিল।  তাদের মধ্যে একজনের নাম সুনীল মাহাতো। বাড়ি পুরুলিয়া। খুব স্মার্ট আর রসিক।

আমার অফিসের বড়বাবুও খুব পুরোনো লোক। বহুদিন ধরে ডিপার্টমেন্টে আছেন। আমার সাথে চাকুরীর শুরু থেকেই পরিচয়। এই বড়বাবুর মেয়ের বিয়ে। দিনটা পড়েছে ৮ই মে। অর্থাৎ ২৫ শে বৈশাখ। বেশ গরম।  বিয়েতে যেতেই হবে।

যাই হোক বিয়ের দিন একটা গাড়ি করে বড়বাবুর বাড়িতে গেলাম। সাথে আমাদের অফিসের কেমিস্ট শ্যামল। শ্যামলের সাথে আমার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব বহুদিনের।  সেখানে গল্পগুজব করে খেয়েদেয়ে যখন উঠলাম তখন রাত এগারোটা। আর তখনই খেয়াল হল রাত্রে কোথায় গিয়ে থাকব। শ্যামল বলল চল প্রদীপদা একটা হোটেলে গিয়ে রাতাটা কাটিয়ে দিই।

সেই রাত্রে মনে হল বাঁকুড়ার সব মেয়ের বিয়ে এক দিনেই সা্রা হয়ে যাচ্ছে। সব কটা হোটেল বিয়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। একটাও জায়গা নেই। কি করা যায়। এত রাতে ভগবানপুরে ফেরাটা ঠিক হবে কিনা ভাবলাম। রাস্তাটা ভালো নয়, রাতের বেলায়। তার উপর বিয়ের তারিখ। এসব ভেবে ভাবলাম যাই অফিসেই গিয়ে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার অফিস সেই চারতলায়। কেয়ারটেকার চারতলার উপরে ছাদে গিয়ে শুয়ে ঘুম দিয়েছে। অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙ্গাতে পারলাম না।

অগত্যা ঠিক হল ভগবানপুরেই যাব। বাঁকুড়া শহর থেকে বেরিয়ে পুয়াবাগান পার হলে দুটো রাস্তা দুদিকে গিয়েছে। ডানদিকেরটা গিয়েছে পায়রাচালি হয়ে পুরুলিয়া। ভগবানপুর এই রাস্তাতেই পড়ে। আমরা পায়রাচালির রাস্তা ধরলাম। আমাদের সাথে রয়েছে ড্রাইভার আবদুল। খুব করিৎকর্মা ছেলে। ড্রাইভার হিসাবেও বেশ পটু।

তখন রাত প্রায় বারোটা। একেই গ্রাম দেশ। তার উপরে অত রাত। কাজেই চারদিক শুনশান। রাস্তায় আমরা আর আমাদের গাড়ি ছাড়া একটিও প্রাণি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কাশিবেদ্যা গ্রাম পার হলাম । এর পরের গ্রাম কালাপাত্থর।

কালা পাত্থরের পরে রাস্তায় একটা কালভার্ট পড়ে। তার কাছাকাছি যেতেই দেখি কালভার্ট জুড়ে কারা যেন রাস্তার পিলার ফেলে রেখেছে। রাস্তা বন্ধ। আমি নেমে  ওগুলো সরাতে যাব ভাবছি, এমন সময় আবদুল বলল, এক্ষুনি এখান থেকে পালিয়ে চলুন। ডাকাত আছে। আমি কিছু বলার আগেই আবদুল কি করে যেন গাড়িটা ঘুরিয়ে আবার বাঁকুড়ার দিকে দৌর লাগালো। আমাকে বলল পিছনে তাকিয়ে দেখুন। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি চার পাঁচজন লোক রাস্তার ধারের মাঠ থেকে উঠে আমাদের গাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।

আমরা আবার বাঁকুড়ার দিকে ফিরে চললাম। আজ রাতটা না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে দেখছি। এই সব বলতে বলতে যাচ্ছি। এমন সময় কাশীবেদ্যার কাছা কাছি দেখি দূর থেকে একটা হাড়ি আসছে। দুটো হেডলাইট জ্বলছে। আমি বললাম ওটাকে থামাতে হবে। কারণ ওখানে গেলে ওরা ডাকাতে হাতে পড়বে। আমি আবদুলকে বললাম, গাড়ি থামাও।

আবদুল রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেডলাইট ডিমারে দিয়ে দিল।  দূর থেকে গাড়িটা মিনিট খানেকের মধ্যেই কাছে এসে গেল। কাছে আসতে দেখি, গাড়ি নয়। দুটো মোটর সাইকেল। তাতে দুজন পাজামা পাঞ্জাবী পরা লোক বসে রয়েছে। আমাদের দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। আমি বললাম , আপনারা আর এগোবেন না। রাস্তায় ডাকাত আছে। কালভার্টের উপর পিলার ফেলে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে।

দুজনের মধ্যে একজন বলল, আপনারা কারা? আই আমার পরিচয় পত্র দেখালাম। বলয়াম আমাদের দুর্ভোগের কথা, একটু একটু। অদের মধ্যে একজন বলল, ভয় নেই আমরা কোতোয়ালি থানার লোক। উনি টাউন দারোগা। চলুন আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।

আমরা আবার গাড়ি ঘুরিয়ে ভগবানপুরের দিকে ফিরে চললাম। এবার একটূ অন্যরকম ব্যবস্থা। আমাদের সামনে দুজন পুলিশ মোটর বাইক নিয়ে আমাদের এসকর্ট করছে।  বেশ একটু গর্ববোধ হতে লাগল।

কালভার্টের সামনে এসে দেখি পিলারগুলো যেরকম ছিল সেরকমভাবেই পড়ে আছে। পুলিশ অফিসার দুজন বাইক থামিয়ে নেমে পিলারগুলো সরিয়ে দিয়ে আমাদের বলল, এবার আপনারা যান, আর কিছু হবেনা।

ভগবানপুর আমার ডেরায় এসে দেখলাম সুনীল মাহাতো জেগে বসে আছে। আমাদের দেখে একটু অবাক হল। বলল এত রাঁইতে?
আমি বললাম, জানো? আমাদের রাস্তায় ডাকাত ধরেছিল। তারপর তাকে আদ্যপান্ত সব বললাম
সুনীল শুনে বলল আমাকে আগে বুইলবেন তো স্যার ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? তোমাকে আগে বললে কি হত?
সে বল, আমি ভজাইঁন দিতাম।
এবার আমার অবাক হবার পালা। ভজাইঁন দিতাম মানে? সুনীল ডাকাতদের চেনে নাকি?
  এর উত্তরে সুনীল যা বলল তাহল, পুরুলিয়া বাঁকুড়া রুটে তাদের একটা বাস চলে। এই বাসে যাতে ডাকাতি না হয় তার জন্য কাশিবেদ্যার এক চায়ের দোকানে তারা প্রতিমাসে টাকা জমা দেয়।
 ওই চায়ের দোকানের মালিক আসলে একজন ছোট এজেন্ট। যারা ডাকাতি করে তারাও আসল ডাকাত নয়। আসল ডাকাত পর্দার আড়ালে থাকে। সিংহভাগ সেই নেয়। যারা ডাকাতি করে তাদের ভাগ্যে সামান্যই জোটে।
এর প্রমাণ পেলাম কয়েকদিন পরে।

আমাদের ক্যাম্পের কুয়োতে কয়েকদিন ধরে বিশেষ জল পাওয়া যাচ্ছে না। কুয়োটা আরো একটু গভীর করতে হবে। সুনীল খবর দেওয়ায় কয়েকজন মজুর সকালবেলায় এসে হাজির কুয়ো খুঁড়তে। সেদিন রবিবার। এমি একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি। সুনীল আমাকে ডাকল, স্যার আসেন একটু।

কুয়োর কাছে গিয়ে দেখি কতগুলি রোগা রোগা না খেতে পাওয়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে দুজনকে দেখিয়ে সুনীল বলল, সার কে দেইখে রাখ।
লোকগুলোর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শুকনো, রোগা, খেতে না পাওয়া দুজন হতদরিদ্র মানুষ। এরাই নাকি ডাকাত!
পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে এদের ডাকাতি করে যেতে হয় নিয়মিত। তারপরেও এরা দরিদ্রসীমার উপরে উঠতে পারেনা। ডাকাতি না করলে এরা বাঁচতে পারবেনা। ডাকাতি ছাড়লেই এদের পুলিশে ধরবে এবং বাকি জীবনটা জেলেই কাটাতে হবে।

AdSense