আসুন দেখে যান,
আনন্দবাজার পত্রিকায় পাকুড় থেকে লেখা এক ব্যক্তির চিঠি ছাপা হয়েছিল। তিনি লিখেছেন
“এখানে দলদলি পাহাড়ের উপরে বিশাল বিশাল পাথরের কড়ি বর্গা ছড়ানো রায়েছে। কারা
পাহাড়ের মাথায় এসব বয়ে নিয়ে এলো? যারা এনেছে তারা কি গ্রহান্তরের মানুষ?”
সত্তরের দশকের
মাঝামাঝি, তখন দানিকেনের পপুলারিটির যুগ। দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ?,
নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন, ইত্যাদি বইগুলো পড়ে মাথায় নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়। বন্ধু
দিবাকর বলল, চল ঘুরে আসি।
চিঠিটার মধ্যে আরও
অনেক কিছু লেখা ছিল। কিন্তু সেসব আর চোখে পড়েনি। শুধু স্টেশনের নাম বারহারোয়া আর
দলদলি পাহাড়ের নাম মাথায় ছিল। একদিন জুন মাসে খুব ভোরে আমি আর দিবাকর নামলাম বারহারোয়া
স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দলদলি পাহাড়ে যাব শুনে বলল উঠে
আসুন।
বাস বারহারোয়া শহরের
ভিতর দিয়ে চলল। পশ্চিমবঙ্গ বিহার (এখন ঝাড়খন্ড) সীমান্তে ছোট্ট শহর, তিন দিকে ঘেরা রাজমহলের
পাহাড়। শহর ছাড়িয়ে একটু যেতেই দেখলাম লেখা রয়েছে “ ঘাট আরম্ভ”। ঘাট পেরিয়ে বাস
যেখানে এলো তার চারদিক ঘিরে রয়েছে রাজমহলের ফ্ল্যাট টপ পাহাড়ের সারি এর নীচে একটা
লতানো নদী, নাম গুমনি। গুমনি নদী রাজমহল পাহাড় থেকে বেরিয়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। গূমনি
পার হয়ে কিছু দূর এগোতেই কন্ডাক্টার বলল দলদলি এসে গিয়েছে। আমরা নামালাম। সামনে
প্রায় হাজার ফুট উঁচু পাহাড়।
পাহাড় দেখে সত্যিই
মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রাস্তার ধার থেকে সটান উঠে গিয়েছে বেশ কয়েকশো ফুট। পাহাড়ের গোড়ায়
ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রান্তর। বেশ কিছু দূরে একটা সাঁওতালি গ্রাম। একটা ছোট্ট রাস্তা
গ্রামের ভিতর চলে গিয়েছে। গ্রাম পার হতেই দেখলাম পথ শেষ। শুধু মাঠ, বড় বড় কিছু গাছ
আর ঝাঁটি বন।
বাংলো থেকে দলদলি পাহাড়
দলদলি পাহাড়ের গোড়া, এখান থেকেই ওঠা শুরু
দিবাকর বলল, কোনখান দিয়ে উঠবি? রাস্তা তো দেখছিনা।
বললাম, রাস্তার
দরকার নেই, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যাব। ঠিক একটা পথ পেয়ে যাব।
তাই হল, কিছুটা
উঠতেই দেখলাম পাহাড়ের গা বেয়ে একটা খুব শরু পথ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। কালো কালো
পাথরের নুড়িতে ভরা সেই পথ। একজনের বেশি ওই পথ দিয়ে যেতে পারে না।
পাহাড়টা ন্যাড়া নয়।
পুরোটাই প্রায় ঘাস আর ছোট গাছে ঢাকা। কিছু কিছু ফল গাছও রয়েছে। তার মধ্যে দেখলাম
কদবেল আর আতা গাছ আছে। পাকা ফল দেখলাম না। পাহাড়ের মাথায় উঠতে প্রায় একঘন্টা লেগে
গেল।
মাথায় উঠে দেখি নীচে
বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিছু দূরে বেশ বড় একটা গঞ্জ মতন রয়েছে। চারপাশে একই
রকমের অনেক পাহাড় রয়েছে। পাহাড়গুলির মাথায় বর্ষার মেঘ জমে রয়েছে। আমি ভাবলাম
বৃষ্টি হলে তো কোথাও আশ্রয় নেবার উপায় নাই। পাহাড়ের মাথাটা একদম সমতল। মাঠের মত।
যাই হোক, যে জন্য
আসা সেই পাথরের কড়ি বর্গা কোথায় রয়েছে খুঁজে দেখতে হবে। বেশি খুঁজতে হলনা। বড়বড়
ঘাসে ঢাকা মাঠের মধ্যেই কয়েকটা বিশাল বড় পাথরের থাম পড়ে রয়েছে। এক একটা ছয় সাত ফুট
লম্বা, আর ছয়কোনা। সব কটিই বেসাল্টের কলাম।
বেসাল্টের কলাম দেখে
বিশেষ বিষ্মিত হলাম না। কারণ রাজমহলের প্রতিটি পাহাড় আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরি। আজ
থেকে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে এখানে আগ্নেয় প্রবাহ ঘটেছিল। বারবার পরতে পরতে। বহু
হাজার বছর ধরে। বেসাল্ট জমে যাওয়ার পরে যখন ঠান্ডা হয় তখন সংকুচিত হওয়ার কারণে তার
মধ্যে ছয়কোনা ফাটল তৈরি হয়। এই ফাটলগুলি বেশ কিছু গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে
সেগুলি যখন ভেঙ্গে যায় অনেকটা ছয়কোনা পাথরের পিলারের আকার নেয়। স্বাভাবিকভাবেই। এর
পিছনে পৃথিবী বা গ্রহান্তরের মানুষের হাত নেই।
কিন্তু এই পাথরগুলো
এই পাহাড়ের মাথায় এভাবে সাজিয়ে রাখল কারা? এর পিছনে তো মানুষের হাত রয়েছে। কারা এই
ভারি পাথরের পিলারগুলি বয়ে আনল, আর কেনই বা আনল? এক জায়গাতেই এই রকম কয়েকটা পাথর
দেখলাম। বাকি পাহাড়ের মাথায় কিছুই নেই। শুধু ঘাসবন আর ঝাঁটির ঝোপ। আমার মনে কিরকম
যেন সন্দেহ দেখা দিল। এই পাথর যারা এনেছে তারা এখনকার আধুনিক মানুষ নয়। হয়তো এখানে
বহু প্রাচীন মানুষের বাস ছিল।
যাই হোক, পাহার তো দেখা হল। পাথরের কড়িবর্গারও
সন্ধান পেলাম। এবার নামার পালা। পাহাড় থেকে নীচে তাকাতেই বুঝলাম যে পথে এসেছি সে
পথে নামা সম্ভব নয়। নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরছে। ওঠার সময় উপরের দিকে তাকিয়ে
উঠেছি, তাই উচ্চতার ব্যাপারটা টের পাইনি।
দিবাকর বলল, চল, খুঁজে দেখি কোথাও নিশ্চয়ই ঝর্ণা
আছে। সেখান দিয়ে নামা সহজ হবে। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর সত্যিই একটা ঝর্ণা
পেলাম। বেশ একটা ভ্যালি মতন আছে। খাড়াইও বেশি নয়। নামা যাবে। তবে পাথরের উপর দিয়ে
লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে হবে।
অরণ্যময় উপত্যকা
নামার পথে দেখলাম চারপাশে নানা রকমের সুন্দর
সুন্দর পাথর পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে অ্যাগেট। অ্যাগেটের ছড়াছড়ি, নানান
সাইজের আর নানা রঙের। আর আছে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল। একটু খুঁজে বেশ কিছু
অ্যামেথিস্টের ক্রিস্টালও পেলাম। কিন্তু পাথরের খাঁজ থেক একটা বড়সর পাথর তুলে আমার
চক্ষু স্থির হয়ে গেল। একটা ফ্লিন্ট বা চকমকি পাথরের টুকরো। ফ্লিন্ট এখানে প্রচুর
রয়েছে। সর্বত্র ফ্লিন্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু এটা একেবারে অন্যরকম। পরিস্কার বোঝা
যাচ্ছে এই পাথরে মানুষে হাতের কারিকুরি রয়েছে। যাকে বলে আর্টিফ্যাক্ট। পাথরটাকে
হাতে তুলে আমার আর সন্দেহ রইল না যে এটা
একটা হ্যান্ড এক্স বা হাত কুঠার। প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্র।
পাথরের অস্ত্রঃ বর্তমানে জলপাইগুড়ির সায়েন্স ক্লাবের সংগ্রহে আছে
চারদিক নির্জন বহু দূর পর্যন্ত লোকের বসতি দেখা যাচ্ছে না। আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেখানে একদিন প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষেরা এসেছিল। হয়তো শিকার করতে গিয়ে হাত থেকে খসে পড়েছিল এই পাথর। আজ এতকাল পরে সেটি আমার হাতে উঠে এসছে।
পাহার থেকে নামার
পথে আর একটা ফ্লিন্টের টুকরো কুড়িয়ে নিলাম । এটা হাত কুঠার নয়, আকারেও ছোটো।
কিন্তু পাতলা এই পাথরের ধারগুলি বেশ নিপুনতার সাথে ভেঙে ধারালো করা হয়েছে। ঘড়িতে
দেখলাম প্রায় দুপুর একটা। বেশ খিদে পেয়েছে। খেতে গেলে যেতে হবে পাহাড়ের মাথা থেকে
যে গঞ্জটা দেখা যাচ্ছিল সেখানে।
গঞ্জ পর্যন্ত হেঁটে
যেতে আরো এক ঘন্টা লাগল। গঞ্জটা বেশ বড়ই। নাম বারহেট। পাকুড় থেকে দুমকা যাওয়ার পথে
পড়ে। এটা একটা ব্লক হেডকোয়াটার্সও বটে। থানা আছে। ভাষা মূলতঃ বাংলা চলে। সেই সময়টা
বড় সুন্দর ছিল। মানুষের মনে ভয়, সন্দেহ এসব কম ছিল। সহজেই বেশ কিছু লোকের সাথে
আলাপ হয়ে গেল। তাদের কাছে শুনলাম এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গুমনি নদী
পার হয়ে গেলে একটা গুহা আছে। তার মাম শিবগদ্দি। লোকে সেখানে শিব পুজা করতে যায়।
কথিত আছে গুহাটা নাকি সাহেবগঞ্জ পর্যন্ত ছিল। ইংরেজরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এই
বারহেটে একটা পুকুর আছে, তার ধারে মাটিতে খুঁজলে পাথরের চাল, ডাল ইত্যাদি পাওয়া
যায়।
পাথরের অস্ত্র সংগ্রহের জায়গা
খাওয়াদাওয়ার পর পুকুরের ধারে গিয়ে মাটি খুঁড়ে
কিছু পাথরের চাল আর ডাল সংগ্রহ করলাম। একজন আমাদের জানালো কোন এক সাধুর অভিশাপে
নাকি এখানে সমস্ত খাদ্য শষ্য পাথর হয়ে গিয়েছে।
সেবার বারহেটে
রাত্রিবাস করিনি। সে রাত্রেই কোলকাতা ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ পাথরে অস্ত্র আর
চালডালের রহস্য মাথার মধ্যে ঘুরতেই থাকল কয়েকদিন ধরে। পাথরের অস্ত্রগুলি দেখালাম
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগে। তাঁরা ওগুলিকে প্রাচীন প্রস্তর যূগের অস্ত্র
বলেই সনাক্ত করলেন। বললেন আমারা আগে নাকি আর কেঊ এটা সম্বন্ধে রিপোর্ট করেনি।
এক মাস পরে আবার
গেলাম বারহেট। এবার একটু থাকার প্রস্তুতি নিয়ে। আমার সাথে এলো নৃতত্বের একজন
গবেষক, সোমনাথ। আমরা ওখানে আরো কিছু প্রাচীন প্রস্তর যুগের সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে
পেলাম। প্রচুর অস্ত্রও সংগ্রহ করলাম।
এরও কয়েক বছর পরে
আবার গেলাম সেখানে। তখন বারহেট অনেক বদলেছে। গুমনি নদীতে একটা বাঁধের নির্মানকার্য
চলছে। একটা বাঙলোও হয়েছে, যেখানে রাত্রীবাস করা যায়। গুমনি পায়ে হেঁটে পেরিয়ে
শিবগাড্ডি পাহাড়ে গেলাম। ভারি সুন্দর জায়গা। বিশাল বেসাল্টের ক্লিফের নীচে একটা
গুহা। গুহার মাথার উপরে বেসাল্টের কলাম ঝুলছে। একটা মন্দির আছে। কিন্তু বিশেষ
লোকজনের দেখা পেলামনা।
এর পরে আরো কয়েকবার
সেখানে গিয়েছি। মূলতঃ কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল আর জিওড সংগ্রহ করার জন্য। অনেক বন্ধুদের
সাথে নিয়ে গিয়েছি। সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল ওই নির্জন পরিবেশ।
সব শেষে গেলাম ২০০৬
এ। প্রথম দেখার প্রায় ত্রিশ বছর পরে। গিয়ে দেখলাম বারহেট থেকে শিবগাড্ডি পর্যন্ত
পাকা রাস্তা হয়ে গিয়েছে। অটো চলে। যে প্রাকৃতিক নির্জনতা ছিল তা অন্তর্হিত।
রাস্তার উপর এক বিশাল তোরণ বানানো হায়েছে শিবগাড্ডির যাত্রীদের আকর্ষন করার জন্য। শিবগাড্ডিতে
স্কুল হয়েছে পান্থশালা হয়েছে। মোবাইল টাওয়ার বসেছে। কিন্তু ধার্মিক মানুষেরা গুহার মুখটি গ্রিল আর
লোহার দরজা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এই গুহা আগ্নেয় প্রবাহের ফল স্বরূপ প্রাকৃতিক
কারণেই জন্মেছিল। লাভা প্রবাহের বাইরেটা জমে শক্ত হয়ে যাওয়ার পরে এই গুহামুখ দিয়ে
ভিতরের তরল লাভা বেরিয়ে এসেছিল। হয়তো প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষেরা এই গুহাতেই আশ্রয় নিত।
শিবগাদ্দি : বেসাল্টের গুহা
ধর্মের চাপে আমাদের
প্রাগৈতিহাস আর প্রকৃতির ইতিহাস দুইই লুপ্ত হয়ে গেল।
ইরিগেশন বাংলো
রাত্রে বাংলোতেই
ছিলাম। বাংলোটা এখনও একই রকম রয়েছে। তবে খাওয়ার ঘরে ফ্রিজ বসেছে। শোয়ার ঘরে এসি
রয়েছে। আমি চৌকিদারকে বললাম এসি চালিয়ে দিতে। তার উত্তরে সে বলল, এখানে সবই আছে,
এসি ফ্রিজ, জলের পাম্প ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পঁচিশ বছরের মধ্যে এখানে
বিদ্যুত আসেনি একবারও।