সন্ধ্যা সাতটা। আমি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বিবেকদের বাড়ির গলির মুখে পাকা
পুলে। আমি, বিবেক আর জয়েশ। পুলের পাশে পাকা রেলিং এর উপর বসে আছে একটা মেয়ে। পরণে লাল
রঙের একটা শাড়ি। হাতে দুগাছা সোনার চুড়ি, গলায় একটা সোনার হার। মেয়েটা মাথা নীচু করে
বসে আছে। কী ভাবছে কে জানে।
একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। পুলের উপর জল জমে আছে। আকাশ মেঘলা।
আবারো বৃষ্টি নামতে পারে।
বিবেক প্রথমে মুখ খুলল, “শালা লালুটার আক্কেল দ্যাখ। সাতটা বাজল এখনও পাত্তা
নাই”।
জয়েশ বলল, “হাট বাসের সময় ঠিক থাকেনা। কোথায় বাস নিয়া গ্যাসে আজকে? হলদিবাড়ি
না মন্ডলঘাট?”
বিবেক বলল, “মন্ডলঘাট। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে মেয়েটাকে বসায়ে রাখব বলতো?”
জয়েশ বলল, “বসায় রাখতে না পারলে বাড়ি নিয়া যা, কখন আসছে! খিদা লাগছে বোধ
হয়”। তারপর মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল, “কিছু খাবা? বিস্কুট আর চা নিয়া আসি?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। খাবেনা।
বিবেক মেয়েটাকে বলল, “তোমার কাছে টাকা আছে?”
মেয়েটা মুঠ খুলে দেখালো, কয়েকটা দশ টাকার নোট। বলল, “বাবা আসার সময় এই একশ
টাকা দিসে, আর এই গলার হার। বলছে, এই দিয়া বিদায় দিলাম। বাড়ি ফিরবিনা কইয়া দিলাম”।
বিবেক বলল, “বাবা মার অমতে বিয়া করবা, তাও আবার হাট বাসের কন্ডাক্টার। লালুর
মধ্যে তুমি যে কী দেখলা”।
মেয়েটা ককিয়ে উঠল, “বিবেকদা, আমি লালুকে ভালোবাসি”।
বিবেক খুব তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “হ্যা, জানি জানি”।
আমি এবার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। চেনা চেনা লাগল। বিবেক বলল, “তুই দেখসিস
ওকে। আমাদের নারায়ণদা আছে না? কদমতলায় সাইকেলের দোকান। ওই নারায়ণদার বড় মেয়ে। দেশবন্ধু
স্কুলে পড়ে”।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। লালুকেও
আমি চিনিনা। তাই বললাম, “মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসছিস কেন?”
বিবেক বলল, “ওর বিয়া। আজকে লালুর সাথে। সকালে বাড়ি গিয়া নারায়ণদাকে থ্রেট
দিসি, মেয়ের বিয়া লালুর সাথে না দিলে ওর আর বিয়াই হবেনা। সন্ধ্যা বেলায় ছাইরা দিসে।
এখন লালুর পাত্তা নাই”।
বিবেক আমার জীবনের প্রথম বন্ধু। প্রথম বন্ধু হলেও এখন আমার সাথে তত ভাব
নেই। আমি কলকাতায় ইউনিভারসিটিতে পড়ি। ওরা কোনো রকমে স্কুলের গন্ডী পার হয়ে কলেজে যাচ্ছে
বা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। তাই ওদের সাথে আমার একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিবেকদের একটা ক্লাব আছে, নাইন বুলেটস। পাড়ার নজন
বকাটে মস্তান ছেলেদের ক্লাব। কাজের মধ্যে, ফুটবল খেলা, আড্ডা মারা, মারামারি করা আর
কালীপূজা আর সরস্বতী পূজা করা। এবছর সরস্বতী পূজার পর থেকে নাইন বুলেটস একটু সমস্যায়
পড়েছে। তার কারণ ওরা সরস্বতী প্রতিমা বসিয়েছিল একটা গাছের উপর। পুরোহিতকে মই দিয়ে ঠেলে
ঠুলে উপরে তুলে পূজা করিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে পুরুৎমশাইয়ের হাত
ভেঙে গিয়েছে। তাই শহরের সব পুরোহিত ওদের দেখলেই পালায়।
বিবেক একটা চটি বই আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “এইটা রাখ। বিয়ার সব মন্ত্রগুলি
এখানে লেখা আসে”। আমি তো অবাক, “সেকিরে, আমি মন্ত্র দিয়ে কী করব?”
বিবেক বলল, “পান্ডাপাড়া কালীবাড়ির ঠাকুরমশাই বিয়া দিবে। মন্ত্র জানে কিনা
কে জানে। তাই আমাদের ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রের বইটা ঝাইপা আনসি”।
লালু এলো। রোগা কালো, গায়ের জামাটা নোংরা, ঘামে জব জব করছে। এসেই বিবেককে
বলল, “বৌ বাজারে বাসটা রাইখা, এই আসলাম। অনেক দেরি হইয়া গেলো”।
লালুর হাতে একটা পুঁটলি। সেটা খুলে লালু দুটো ফুলের মালা বের করল, আর একটা
সাদা পাঞ্জাবী। “হাটের থেকে কিনা আনলাম”। তারপর মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, “এই তো আমি
আসছি। ভাবনার কিছু নাই”।
লালু গায়ের জামাটা খুলে আমার সাইকেলের কেরিয়ারে গুঁজে দিলো। তারপর রাস্তার
কল থেকে জল নিয়ে মুখ হাত ধুয়ে পাঞ্জাবীটা পরে নিলো।
আমরা রওনা হলাম। বিবেকের সাইকেলের রডে মেয়েটা। জয়েশের সাইকেলে লালু আর জয়েশ।
আটটা বেজে গিয়েছে। জলপাইগুড়ি শহর এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তায় একটাও রিক্সা নেই।
পুরোনো শিরিষ গাছের ক্যানোপির নীচে রাস্তার ধারে পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি। স্থান
মাহাত্য আছে। আমাদের দেখেই পুরুৎমশাই, “বাবারা আমি একটু আসতাসি,” বলে বেরিয়ে চলে গেলো।
বিবেক বলল, “আর আসবেনা, আমাদের দেখে ভাগসে। পুরুৎ ছাড়াই বিয়া হবে। মা কালী সামনে আছেনা?”
জয়েশ মন্দিরের সবদিক হাতরে পাতরে কয়েক টুকরা পাটখড়ি জোগাড় করে ফেলল। একটা
শিশিতে সর্ষের তেল ছিল। তাই ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালালো। বিবেক আমার দিকে ফিরে বলল, “তুই
মন্ত্র বল। অগ্নি সাক্ষি করে বিয়া হবে। তুই বিয়া দিবি”।
আমি বললাম, “তুই তো চক্রবর্তী ব্রাহ্মন। তুই বিয়েটা দে”।
বিবেক হেসে বলল, “দূর, আমি আবার কি ব্রাহ্মন। মন্ত্র উচ্চারণ করতেই পারবনা।
তুই কবিতা টবিতা লিখিস। তুই ভালো বলতে পারবি”।
আমি সম্প্রদানের মন্ত্র পড়লাম, মালা বদল হল। সিঁদুর পড়ানো হল। আমি ওদের
দিয়ে বলালাম, “যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম”। সাত পাক ঘোরানো হল। মন্দিরে একটা
পাত্রে কিছু সন্দেশ আর বাতাসা পড়ে ছিলো তাই দিয়ে মিষ্টিমুখ হল।
এই ফাঁকে কখন যেন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে শিরিষ
গাছের ফাঁক দিয়ে তারা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় ঝর ঝর করে গাছবৃষ্টি ঝরছে।
আমরা আবার সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম। লালুর বাড়ি যাবো। টাউনক্লাবের মাঠের পাশ
দিয়ে যে রাস্তাটা তিস্তার বাঁধের দিকে গিয়েছে সেই রাস্তায় বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে থামলাম।
সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে। তিস্তার চরে নতুন যে বসতি তৈরি হয়েছে বন্যার পরে,
সেখানে থাকে লালু।
লালুর বাড়ি, বাড়ি না বলে ছাউনি বলাই ভালো। কয়েকটা কাঠের খুঁটির উপর উঁচু
একটা কাঠের পাটাতন। তার উপরে মুলি বাঁশের বেড়া দেওয়া একটা মাত্র ঘর। টিনের চাল। লালু
ঘরে সামনে গিয়ে মা, মা, করে হাঁক দিতেই সাদা থান পরা এক মহিলা নেমে এলো। লালুকে আর
বৌ কে দেখে অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে উলুধ্বনি দিয়ে উঠল। তারপর
মেয়েটার হাত ধরে বলল, “আসো মা ঘরে আসো”।
লালু আমাদের দিকে ফিরে বলল, “যা তোরা এবার বাড়ি যা”।
আজ একান্ন বছর পার হয়ে গেছে। এখনও মেয়েটার মুখ মনে ভাসে। বিয়ের পর কেমন
ছিল কে জানে। এখন কেমন আছে কে জানে।