এই গল্পের সবটুকুই শুনেছি
অগ্রজপ্রতীম অধুনা প্রয়াত ভূতাত্বিক পতাকীরাম চন্দ্রের মুখ থেকে। ভারতের ভূতত্বের
জগতের অনেকের কাছেই পতাকীদা একটি অতি পরিচিত নাম, বিশেষ করে তাঁর অসাধারণ গল্প
বলার কুশলতার জন্য।
গল্পের পটভূমি সদ্য
স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষ।
১৯৪৮ সালে কেরামতি আও
নামে একজন নাগা ছাত্র আসাম থেকে ভূতত্ব নিয়ে বিএসসি পাশ করে। ফল আশানুরূপ হয়নি।
তার ধারণা হয়েছিল সে নাগা বলে তাকে কম নম্বর দেওয়া হয়েছিল। সে ঠিক করল কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এসসি পাশ করবে। কেরামতি তার গ্রামের একমাত্র ছাত্র যে গ্রাম
পার হয়ে প্রথম উচ্চশিক্ষার জগতে প্রবেশ করেছে।
সে সময় কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের ক্লাস হত প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতত্ব বিভাগেই,
অর্থাৎ বেকার ল্যাবরেটারিতে। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অধ্যাপক নির্মল মুখার্জী।
কেরামতি এসে সোজাসুজি নির্মলবাবুর সাথে দেখা করল। নির্মলবাবু সব শুনে বললেন, এত
দেরি করে এসেছ? মাত্র দশটা সিট, সব কটি ভর্তি হয়ে গিয়েছে। তাই শুনে তো কেরামতি
কান্নাকাটি শুরু করে দিল। নির্মলবাবুর একটু দয়া হল। বললেন, চল প্রমথবাবুর কাছে
যাই, দেখি উনি কি বলেন।
প্রমথবাবু হলেন প্রমথনাথ
ব্যানার্জী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি মন দিয়ে সব শুনে একটু ভাবলেন,
তারপর নির্মলবাবুকে বললেন, নাগাল্যান্ড থেকে প্রথম একজন উচ্চশিক্ষা পেতে চলেছে।
একে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। আপনি ওকে নিয়ে নিন। নির্মলবাবু বললেন, কি করে
হবে? সব সিট ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
প্রমথবাবু বললেন, আমি
একটা সিট বাড়িয়ে দিচ্ছি। আগামী সেনেটের মিটিং এ পাশ করিয়ে নেবো। আপনি ওকে ভর্তি
করে নিন। কেরামতী তো ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু তার আরো একটা সমস্যা, কলকাতায় থাকবে
কোথায়? আবার নির্মলবাবু তাকে নিয়ে এলেন প্রমথ বাবুর কাছে। প্রমথবাবু বললেন, কোনো
সমস্যা নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা জনে অনেক বাড়ি দান করেছে। শ্যামবাজারে
একটা এরকম খালি বাড়ি আছে। ও আপাততঃ সেখানেই থাকুক। আমি দা্রোয়ানকে বলে দেবো।
কেরামতির একটা হিল্লে হয়ে গেল।
এবার একটু অবনীবাবুর কথায়
আসা যাক। অবনী চৌধুরী নির্মলবাবুর ছাত্র। বছর দুই আগে, মানে স্বাধীনতার আগে, এম
এসসি পাশ করেছেন। মেধাবী ছাত্র, কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি করার জন্য দেশ স্বাধীন
হওয়ার পরেও সরকারী চাকরী হয়নি। নির্মলবাবু একদিন ট্রামে করে যেতে যেতে দেখলেন
ট্রামের কন্ডাক্টার তাঁরই ছাত্র অবনী চৌধুরী। দেখে ওনার খুব খারাপ লাগল। ফলে আবার
সেই প্রমথবাবুর শরণাপন্ন হলেন এবং অবনী চৌধুরীর জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভূতত্ব বিভাগে আরো একটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হল।
কলকাতা বিস্ববিদ্যালয়ের
ক্লাস হত সকাল বেলায়। কেরামতি ভোরে উঠে শ্যামবাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে কলজে আসত।
আবার কলেজের শেষে হেঁটেই ফিরে যেত। গ্রাম থেকে তার পড়ার খরচ বাবদ যে টাকা আসত তাতে
ট্রামে চড়ার পয়সা কুলোতো না। এর মধ্যে একদিন কেরামতি লক্ষ্য করল প্রতিদিন কে যেন
তার পিছু নেয়। লোকটা শ্যামবাজার থেকে ওর পিছন পিছ হাঁটতে হাঁটতে বেকার ল্যাবরেটারি
পর্যন্ত আসে, তারপর আবার চলে যায়।
থাকতে না পেরে কেরামতি
একদিন ব্যাপারটা অবনীবাবুকে বলল। অবনীবাবু মেধাবী ছাত্র বলে, কেরামতিকে খুব ভালো
বাসতেন। বললেন, ঠিক আছে একদিন ব্যাপারটা
দেখতে হবে।
পরদিন ভোরে অবনীবাবু
বেকার ল্যাবরেটারির গেটের পাশে দরজার আড়ালে লুকিয়ে রইলেন। লোকটা ভিতরে ঢুকতেই
অবনীবাবু তাকে জাপটে ধরে দারোয়ানকে ডাকতে থাকলেন। অবনীবাবুর বেশ বলিষ্ঠ চেহারা।
কিন্তু লোকটা এক ঝটকায় অবনীবাবুর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে পকেট থেকে একটা পিস্তল
বের করে অবনীবাবুকে তাগ করে বলল, হ্যান্ডস আপ। অবনীবাবু তাতে দমবার পাত্র নন, তিনি
এক থাবড়ায় লোকটার হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিয়ে এক লাথিতে সেটাকে নিজের ঘরের দিকে
পাঠিয়ে দিলেন।
এইবারে লোকটা নরম হল। তারপর
পকেট থেকে নিজের পরিচয়পত্র বের করে বলল, আমি আইবির লোক। আমার উপর নির্দেশ আছে এই
নাগা ছেলেটির উপর নজর রাখার। জানেন তো নাগাল্যান্ডে ভারতবৈরিতা চলছে।
অবনীবাবু বললেন হুঁ, সব
বুঝলাম। কিন্তু আপনি অনুমতি ছাড়া কলেজে ঢুকে অপরাধ করেছেন। এর শাস্তি আপনাকে পেতে
হবে। ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ন্যুনতম শাস্তি আপনাকে দিলাম। আমার ক্লাস শেষ না হওয়া
পর্যন্ত আপনাকে আমার ঘরে বসে থাকতে হবে। লোকটি তাই বসে রইল।
অবশেষে কেরামতির পাঠ শেষ
হল, দেখা গেল সে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। বিশেষ করে অবনীবাবুর পেপারে খুব কম নম্বর
পেয়েছে। অবনীবাবুকে সে কথা বলতেই তিনি কেরামতিকে বললেন, আমি ইচ্ছে করেই তোকে কম
নম্বর দিয়েছি যাতে তুই ফার্স্ট ক্লাস না পাস। ফার্স্ট ক্লাস পেলেই তো তুই জিএসআই
তে চলে যাবি। কিন্তু আমি সেটা চাই না। তুই নাগাল্যান্ডের প্রথম ভূতাত্বিক এবং
তোদের ট্রাইবের মধ্যে প্রথম উচ্চশিক্ষা পেয়েছিস। আমি চাই তুই নাগাল্যান্ডকে গিয়ে সেখানে
তোর সার্ভিস দে। নতুন রাজ্য গঠন হচ্ছে। তুই দেশে ফিরে যা।
কেরামতি অবনীবাবুর কথা
মাথা পেতে নিয়েছিল। পরে সে নাগাল্যান্ডের শিক্ষাদপ্তরের উচ্চতম অধিকর্তা হয়েছিল।
নাগাল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের কাজ সে করে গেছে সারা জীবন।
আর, তারপর যতবার কলকাতায়
এসেছে অবনীবাবুকে প্রণাম করতে ভোলেনি।
No comments:
Post a Comment