Wednesday 24 August 2022

বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের মানচিত্র

 ভূগোলের দৃষ্টিতে চাঁদের পাহাড়

বছর দুই আগে বইয়ের হাটে বিভূতিভূষণের আরণ্যকের উপন্যাসের একটি খসড়া মানচিত্র পোস্ট করেছিলাম। তখন কেউ কেউ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন চাঁদের পাহাড়ের এরকম মানচিত্র রচনা করা্র জন্য।
সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই পোস্ট। বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের মত এত অসামান্য কিশোর উপন্যাস আর কেউ লিখতে পেরেছেন কিনা জানিনা। শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত এই উপন্যাস আমার বহু কাজের অনুপ্রেরণা, আমার কল্পনার বিস্তারের সাথি। কিন্তু ভূগোলের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি উপন্যসটি বিশ্লেষণ করি তবে দু একটা প্রশ্ন মনে আসে।
প্রথম যে প্রশ্ন আমাকে ভাবায় তা হল, চাঁদের পাহাড় উপন্যাসে চাঁদের পাহাড় কোথায়? শঙ্কর চাঁদের পাহাড়ে কি যেতে পেরেছিল? এর উত্তরে বলতে হয় বইয়ের প্রথম দিকে রয়েছে একটা কথা, যা হল , শঙ্করের খুব ভাল লাগে, “প্রসিদ্ধ জার্মান ভূপর্যটক অ্যাণ্টন হাউপ্টমান লিখিত আফ্রিকার একটা বড় পর্বত— মাউনটেন অফ দি মু ন (চাঁদের পাহাড়) আরোহণের অদ্ভুত বিবরণ”। কিন্তু বাকি বইয়ের কোথাও চাঁদের পাহাড়ের কথা নেই। কারণ শঙ্কর সত্যিকারের চাঁদের পাহাড়ের (মাউন্ট রুয়েঞ্জরি) ধারেকাছেও যায়নি। যদিও চাঁদের পাহাড়ের মাত্র ৪০০ মাইল দূরে (কিসুমু) তার প্রথম পোস্টিং ছিলো। চাঁদের পাহাড় আসলে ছিলো শঙ্করের স্বপ্ন এবং তার অভিযানের অনুপ্রেরণা।


শঙ্কর আফ্রিকায় প্রথম পা রাখে মোম্বাসায় এবং সেখান থেকে গিয়েছিল কিসুমু। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, “মোম্বাসা থেকে রেলপথ গিয়েচে কিসুমু-ভিক্টোরিয়া-নায়ানজা হ্রদের ধারে— তারই একটা শাখা লাইন তখন তৈরি হচ্ছিল। জায়গাটা মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল পশ্চিমে। ইউগাণ্ডা রেলওয়ের নুডসবার্গ স্টেশন থেকে বাহাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে”। ---------
----“শঙ্করকে আর কনস্ট্রাকশন তাঁবুতে থাকতে হল না। কিসুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে একটা ছোট স্টেশনে সে স্টেশন মাস্টারের কাজ পেয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই চলে গেল”।
ডিয়াগো আলভারেজের সাথে শঙ্কর প্রথম যাত্রা শুরু করে কিসুমু হয়ে ভিক্টরিয়া নায়ানজায় জাহাজে করে। “আরও দিন দশেক পরে দু’জনে কিসুমু গিয়ে ভিক্টোরিয়া হ্রদে স্টীমার চড়ে দক্ষিণ মেওয়ানজার দিকে যাবে ঠিক করলে”। প্রথম মানচিত্রে এই যাত্রাপথটি দেখানো আছে।
বিভূতিভূষণ লিখেছেন, “ভিক্টোরিয়া হ্রদের যে বন্দরে ওরা নামলে— তার নাম মেওয়ানজা। এখান থেকে তিনশো মাইল দূরে ট্যাবোরা, সেখানে পৌঁছে কয়েক দিন বিশ্রাম করে ওরা যাবে টাঙ্গানিয়াকা হ্রদের তীরবর্তী উজিজি বন্দরে”।
“দিন পনেরো পরে শঙ্কর ও আলভারেজ উজিজি বন্দর থেকে স্টীমারে টাঙ্গানিয়াকা হ্রদে ভাসল। হ্রদ পার হয়ে আলবার্টভিল বলে একটা ছোট শহরে কিছু আবশ্যকীয় জিনিস কিনে নিল। এই শহর থেকে কাবালো পর্যন্ত বেলজিয়ান গভর্ণমেন্টের রেলপথ আছে”।
এই পোস্টে প্রথম মানচিত্রে এই কাবালো পর্যন্ত যাত্রাপথ দেখানো আছে। এর পর থেকেই আসল অ্যাাডভেঞ্চার শুরু হবে।
শঙ্করের আসল অ্যাডভেঞ্চার শুরু হচ্ছে কাবালো থেকে। প্রথম অভি্যান কঙ্গো নদীতে। যদিও এর বর্ণনা উপন্যাসে বিশেষ নেই। কঙ্গো নদীর দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেছে তারা। “সেখান থেকে কঙ্গোনদীতে স্টীমারে চড়ে তিনদিনের পথ সানকিনি যেতে হবে, সানকিনিতে নেমে কঙ্গো নদীর পথ ছেড়ে, দক্ষিণ মুখে অজ্ঞাত বনজঙ্গল ও মরুভূমির দেশে প্রবেশ করতে হবে। কাবালো অতি অপরিষ্কার স্থান, কতকগুলো বর্ণসঙ্কর পর্তুগিজ ও বেলজিয়ানের আড্ডা”।
“পরদিন ওরা কাবালো থেকে স্টীমারে উঠল কঙ্গোনদী বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার জন্যে। নদীর দুই তীরের দৃশ্যে শঙ্করের মন আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে উঠল”। কঙ্গো নদীর দক্ষিণ দিকে যাওয়া মানে উজানে যাওয়া। কঙ্গো নদীর উৎস মধ্য আফ্রিকার রিফট ভ্যালির পাহাড়ের থেকে।
“দু’দিন পরে বোট এসে সানকিনি পৌঁছুল”।
গুগল মানচিত্রে এই সানকিনি স্থানটি খুঁজে পেলাম না। মনে হয় সেটি কোনো বেলজিয়ান নাম, যা পরে বদলে গেছে। তবে কঙ্গোর উজানে সানকাসিয়া বলে একটা জায়গার নাম পেলাম ১৯১৯ সালের একটি মানচিত্রে। ধরে নিই এটাই সানকিনি। (চিত্র ২)


এখানে আসার পরে মনে হয় তারা রোডেশিয়া তে প্রবেশ করে। বিভূতিভূষণ লিখেছেন “মাস দুই ধরে রোডেসিয়া ও এঙ্গোলার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভেল্ড অতিক্রম করে, অবশেষে দূরে মেঘের মতো পর্বতশ্রেণী দেখা গেল। আলভারেজ ম্যাপ মিলিয়ে বললে— ওই হচ্চে আমাদের গন্তব্যস্থান, রিখটারসভেল্ড পর্বত, এখনো এখান থেকে চল্লিশ মাইল হবে। আফ্রিকার এইসব খোলা জায়গায় অনেক দূর থেকে জিনিস দেখা যায়”। এর পর আছে বুনিপ দর্শন। আলভারেজের মৃত্যু, গুহার মধ্যে হীরে পাওয়া। অবশেষে কালাহারি পার হয়ে শঙ্করের চিমানিমানি পর্বতে আরোহণ। “আলভারেজ মিলিটারি ম্যাপ থেকে নোট করেছে যে, এই অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব কোণ লক্ষ্য করে একটি বিশেষ পথ ধরে না গেলে, মাঝামাঝি পার হতে যাওয়ার মানেই মৃত্যু”। আমার ধারণা শঙ্কর কালাহারির উত্তর দিক ঘেঁষে যাত্রা করেছিলো।
এখানে বিভূতিভূষণ লিখেছেন, “চিমানিমানি পর্বত উত্তীর্ণ হতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসলো, ভীষণ প্রজ্বলন্ত কালাহারি পার হতে গিয়েও সে এমন ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়নি”।
পুরানো মানচিত্রে এদের যাত্রাপথটা একটু দেখা যাক। মানচিত্র ৩


এই অসামান্য উপন্যাসটির ভৌগোলিক বিবরণ এতো নিখুঁত যে খুব সহজেই এর মানচিত্র রচনা করা যায়। বইয়ে দু একটা ভৌগোলিক অসঙ্গতি আছে যা নিয়ে আলোচনার লোভ সামলাতে পারছিনা।
এই অসঙ্গতির একটি হল গল্পে রিখটার্সভেল্ডের কাছে একটি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ঘটনা আছে। গল্পে সেটির নাম বলা হয়েছে ‘ওলডোনিও লেঙ্গাই’— প্রাচীন জুলু ভাষায় এর মানে ‘অগ্নিদেবের শয্যা’। আমি নানা মানচিত্র ঘেঁটে যে যাত্রাপথটি এঁকেছি তার ধারেকাছে এই আগ্নেয়গিরিটি নেই। এটির অবস্থান তানজানিয়াতে মানে তখনকার টাঙ্গানাইকায়। আমার ধারণা কেবলমাত্র নাটক রচনার জন্যই বিভূতিভূষণ এই আগ্নেয়গিরিটি গল্পে আমদানি করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ আলভারেজ শঙ্করকে বলেছিলো, “সলস্‌বেরি… এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে আন্দাজ ছশো মাইল”। এটিও একটি ভৌগোলিক অসঙ্গতি বলে মনে হয়েছে। কারণ যে জায়গার থেকে সলিসবেরি পূর্বদক্ষিণে ছশো মাইল সেটি রিখটাররসভেল্ড থেকে অনেক উত্তরে অ্যাঙ্গোলায়, যেখান থেকে সলসবেরি যেতে হলে কালাহারি পার হতে হয় না। আমার মনে হয় পূর্ব-দক্ষিণ না হয়ে ওটা পূর্ব-উত্তর কোণ হবে।
বইটি পড়ার সময় লেখার গুণে কাহিনির দুরন্ত বিস্তারে এসব অসঙ্গতি পাঠকের মনে দাগ কাটার কোনো কারণই নেই। এতে কাহিনির কোনো হানি হয়নি। আফ্রিকায় না গিয়ে শুধুমাত্র মানচিত্র ও ভৌগোলিক বিবরণ পড়ে যিনি এই উপন্যাস রচনা করতে পারেন তাঁর তুলনা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। এই তিনটি মানচিত্র তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ।

No comments:

Post a Comment

AdSense