Thursday, 31 December 2020
পোষাক ও ধর্ম
Saturday, 26 December 2020
বীজপত্র
(গল্প)
বৌদি আর নেই ভাবতে ভীষণ কষ্ট
হল অপর্ণার। বলল, সুবিনয়দা তো এখন নার্সিং
হোমে। বৌদির ওখান থেকে ফেরার পথে সুবিনয়দাকে একবার দেখে আসব।
সামনে হুটার লাগানো পুলিশের
গাড়ি, তারপর সুবিনয়দার মরদেহ নিয়ে গাড়ি। তারপরেই নবনীতার ড্রাইভার কায়দা করে নিজের
গাড়িটা মিছিলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। অপর্ণা তাকিয়ে দেখল কোন মন্ত্রবলে বাইপাসের
সমস্ত গাড়ি স্তব্ধ অচল হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো লাল বাতি নেই। রাস্তাড় মোড়ে মড়ে
পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি। পরমার মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে এগিয়ে চলল শবযাত্রা। পার্ক
সার্কাসের মুখে সব গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সুবিনয়দাকে পথ ছেড়ে দেওয়ার
জন্যই।
পার্ক সার্কাস থেকে
রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত নতুন ফ্লাইওভারটা খুলে দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। অপর্ণা
এখন পর্যন্ত ওটার উপর দিয়ে যায়নি। লম্বা সেতুটার উপরে আজ একটাও গাড়ি নেই। শূণ্যের
মধ্যে লম্বা হয়ে সেতুটা শুয়ে আছে। খোলা রাস্তা পেয়ে পুলিশের গাড়ি আর সুবিনয়দার
মরদেহ নিয়ে গাড়ীটা কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার অপর প্রান্তে অপর্ণার মনে হল, এটাই
যেন সেই অনন্তের রাতা যে পথে চললে এক অবিনশ্বর আনন্দলোকে পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে হল,
এই পথে সুবিনয়দাকে নিয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে শূণ্যে মিলিয়ে যাবে।
আদম ইভের প্রত্যাবর্তন
(কল্পবিশ্ব ওয়েবজিনে প্রকাশিত )
অনীশবাবু প্রতিদিন সকাল বেলায়
লেকে বেড়াতে যান। এটা অভ্যাস করেছেন শুধু শরীরচর্চার জন্যই নয়, ওখানে গেলে বেশ
কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তারাও অনেকে তাঁরই বয়সী, সদ্য রিটেয়ার করেছে। দু একজন
অল্প বয়সীও আছে। তারাও বেশ ভালো, খুব সম্মান দেয়। যেহেতু কলেজে পড়াতেন, অনেকেই
তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করে। এই তো গত টিচার্স ডে তে একজন একটা ব্লু টুথ হেডফোন
উপহার দিয়েছে। সেটা কানে দিয়ে মোবাইল থেকে গান শোনা যায়। অনীশবাবু আজকালকার
টেকনোলজিতে ততটা অভ্যস্ত নন। নিজে কম্পিউটার চালাতে পারেননা। যা দরকার একমাত্র
মেয়ে বসুধাই করে দেয়।
বছর দুয়েক হল নতুন একজন সদস্য
জুটেছে। অবনী দত্ত। তিনি নাকি প্রবাসে ছিলেন। দুবছর হল আলিপুরে বাড়ি কিনে সেখানে স্থিতু হয়েছেন। উনি রত্ন
পাথরের ব্যবসা করে বহু টাকা উপার্জন করেছেন। ভদ্রলোককে দেখলে একটু অবাক লাগে। বয়স
কত বোঝার উপায় নেই। উনি বলেন সত্তর বছর। কিন্তু এই বয়সে চামড়া ওরকম টানটান থাকে
নাকি? বাংলা বলার সময় সম্পূর্ণ বাংলাই ব্যবহার করেন। একটু থেমে থেমে কথা বলেন, মনে
হয় অনেক ভেবে কথা বলছেন। এই দুটি বিষয় ছাড়া আর সব ব্যপারেই স্বাভাবিক। নানা বিষয়ে
জ্ঞান রাখেন। কোনো সমসা হলে চট করে সমাধান বাৎলে দিতে পারেন। আলিপুরে বাড়ি কেনা
সোজা কথা নয়। আর্থিক অবস্থা ভালো বলেই মনে হয়।
অবনী দত্তের ছেলের সাথেও আলাপ
হয়েছে। বছর ত্রিশেক বয়স হবে। সুদর্শন চেহারা। নাম পৃথু, মহাভারতের একটি চরিত্রের নামে
নাম। কথাবার্তায় চমৎকার। সে সকাল বেলায় লেকে দৌড়াতে আসে। আধঘন্টার মত দৌড়ায়। তারপর সবার সাথে কুশল বিনিময়
করে মেনকা সিনেমার উলটো দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। টানটান ঋজু চেহারা। অবনী
দত্তকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন ছেলেটি একজন বিজ্ঞানী। তবে ঠিক কোথাও চাকরী করেনা।
বাড়িতে নিজের গবেষণাগার আছে। ঘরে বসে বিভিন্ন সংস্থাকে বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ দেয়। এর
বেশি কিছু জানা যায়নি।
এই ছেলেটিকে দেখার পর থেকেই
অনীশের মাথায় একটা নতুন ভাবনা এসেছে। পৃথুকে জামাই হিসাবে বসুধার সাথে ভালো
মানাবে। কিন্তু জামাই করার ব্যাপারে কী করে যে কথাটা পারবেন এখনও ভেবে উঠতে
পারেননি।
একদিন হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল।
অবনীবাবু নিজে থেকেই অনীশবাবুকে নিমন্ত্রণ করলেন, এই রবিবার কী করছেন? আসুন না
আমার বাড়িতে সবাই মিলে, একটু চা খাবেন, বিকেলে।
চমৎকার প্রস্তাব, অনীশবাবু
লুফে নিলেন কথাটা, অবশ্যই যাব। বিকেল পাঁচটায় গেলে হবে? আমার স্ত্রী আবার ফেরেন ওই
সময়, স্কুলে পড়ান কিনা।
বেশ তো স্ত্রী আর মেয়েকেও
নিয়ে আসবেন। সবাই মিলে গল্প করা যাবে। আপনার মেয়ে তো এবার
ফিলোজফিতে এম এ পাশ করেছে, তাই না? এম ফিলে ভর্তি হয়েছে।
অনীশ একটু অবাক হলেন, এ কথাটা
অবনী দত্তের জানার কথা নয়। হয়তো অন্য কারো কাছ থেকে জেনেছে। কিন্তু এম ফিলের কথাটা
লেকের বন্ধুদের কাউকে বলেছেন বলে তো মনে পড়েনা।
আলিপুরে এমন একটা পুরোনো বাড়ি
আছে তা অনীশের ধারণাই ছিলনা। বাড়িটা শুধু পুরোনো নয়, বাড়ির আসবাবগুলিও অন্য রকম।
কোনো মিউজিয়ামে গেলে এরকম আসবাব দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ির মাঝখানে একটা চাতাল, তার
চার দিক দিয়ে ঘর। দোতলা, বেশ চওড়া সিঁড়ি। অবনী বললেন, এটা একটা জমিদার বাড়ি। আমি
কিনে নিয়েছি।
অবনীবাবুর ছেলের নাম পৃথু।
সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ছাদের উপরে চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে। দেখা গেল বাড়িতে আর
কোনো কাজের লোক নেই। পৃথুই চা, খাবার সব
নিয়ে আসছে। চমৎকার চা, খাবারও খুব ভালো। অনীশবাবুর মেয়ে বসুধার সাথেও পৃথুর আলাপ
হল। এক সময় দেখা গেল দুজনে আলাদা বসে গল্প
করছে। অনীশবাবু লক্ষ্য করলেন ছাদের উপর অনেকগুলি নানা ধরণের অ্যান্টেনা।
পৃথু বলল, কাকু, আমার কাজটা
একটু অন্য রকমের। আমি একজন অ্যাস্ট্রোবায়লজিস্ট। মহাকাশের অন্য গ্রহের প্রাণ নিয়ে
গবেষণা করি। শুধু পৃথিবীতে নয় মহাশূন্যে আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে বুদ্ধিমান
প্রাণি আছে। আমি মহাকাশের সেই সব গ্রহ থেকে আসা সঙ্কেত এখানে ধরি, সেগুলিকে
বিশ্লেষণ করি। এটাই আমার কাজ। বিশ্বে আরো অনেক সংস্থা আছে যারা এই বিষয়ে গবেষণা
করছে। আমি তাদের সাথে কাজ করি। গোপন কাজ, আশাকরি একথা আপনারা আর কাউকে জানাবেন না।
অনীশ বললেন, না না, আমি আর
কাকে বলব? আমি সাহিত্যের মানুষ, এসব বুঝিনা।
পৃথু বলল, চলুন আমার কাজের ঘর
আপনাকে দেখিয়ে আনি।
পৃথুর কাজের ঘর বলতে ঘর ভর্তি
কয়েকটা কমপিউটার, দেয়াল জুড়ে অসংখ্য আলো আর বোতাম। বাড়ির ভিতরে এরকম একটা
ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা দেখে অনীশ বেশ অবাক হলেন। বসুধাও বেশ অবাক হয়েছে। তার চোখে
মুখে একটা সম্ভ্রমের ছাপ অনীশের দৃষ্টি এড়ালো না। পৃথু ছেলেটাকে তো ভালোই মনে হল।
বসুধার সাথে বিয়ে হলে মন্দ হয় না। শুধু কী করে কথাটা পাড়বেন সেটাই সমস্যা।
কিন্তু তারও সমাধান হয়ে গেল।
পৃথু একদিন নিজে থেকেই অনীশের কাছে প্রস্তাব দিল, আমি বসুধাকে বিয়ে করতে চাই।
বসুধার এতে সম্মতি আছে।
বিয়েটা হল অবনীর বাড়িতেই। উনি
বললেন এত বড় বাড়ি, খালি পড়ে রয়েছে। বিয়ে, বৌভাত দুটোই এখানে হোক। ধুমধাম করে বিয়ে হলেও শুধুমাত্র একবস্ত্রে
মেয়েকে সম্প্রদান করতে হল। শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নেওয়া পৃথুর পছন্দ নয়। অনীশের খুব
ভালো লাগল সেটা। খুব ভালো জামাই পেয়েছেন।
বিয়ের দিন সাতেক পরে
অনীশবাবুর মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। কোথাও একটা
গোলমাল হয়েছে। বসুধা ফোন করছেনা। আজ তিন
দিন হল একবারও ফোন করেনি। একটু চিন্তিত মনে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, বসুধার ফোন
পেয়েছ?
অনীশের স্ত্রী বললেন, না তো!
দিন তিনেক হল বসুধা ফোন করেনি। আমি ভাবলাম তোমাকে বুঝি ফোন করেছে। কী হল মেয়েটার,
একদম খবর নেই।
এরকম হওয়ার কথা নয়। বিয়ের পর
থেকে বসুধা প্রতিদিন ফোনে বাবা মার খবর নেয়। অনীশবাবু খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। বসুধাকে
ফোন করলেন। ফোন থেকে যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো, এই নম্বর এখন উপলব্ধ নয়। বসুধার ফোন
খারাপ ভেবে পৃথুকে ফোন করলেন। সেখান থেকেও একই কথা ভেসে এলো। অনীশ খুব চিন্তায় পড়ে
গেলেন। কী হতে পারে? ওরা কি তবে বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে? গেলেও মা বাবাকে না
জানিয়ে যাবে কেন?
অনীশবাবু বললেন, আজ বিকেলে চল
ওদের বাড়ি যাই।
আলিপুরে অবনীর বাড়ির সামনে
দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ি অন্ধকার। সদর দরজায় তালা ঝুলছে। অনীশ মাথায় হাত দিয়ে
বসে পড়লেন। সবাই উধাও হয়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু না বলেই। তিন জনের এভাবে চলে যাওয়া
মোটেই ভালো মনে হল না। একবার মনে হল মেয়ে দুষ্টু লোকের হাতে পড়েছে। যা দিনকাল,
লোকের ব্যবহার দেখে মতলব বোঝার উপায় নেই। কিন্তু এত টাকা পয়সা যার সে তার মেয়েকে
অপহরণ করবেই বা কেন? যে কারণেই হোক বিষয়টা গভীর দুশ্চিন্তার। এখন একমাত্র উপায়
পুলিশের কাছে যাওয়া।
সব শুনে ওসি প্রথমে খুব ধমকালেন।
আপনারা একেবারে খোঁজখবর না নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফ্রি লান্সার কনসালটিং
বিজ্ঞানী। তার উপরে অন্য গ্রহের প্রাণি নিয়ে গবেষণা। এমন কথা কেউ শুনেছে কখনও। ছবি
আছে?
অনীশ বিয়ের অ্যালবাম সাথে
করেই এনেছেন। ওসি তার থেকে দুটো ছবি খুলে রেখে দিল। বলল, কাল সকালে সার্চ ওয়ারেন্ট
নিয়ে ওই বাড়ি সার্চ করতে যাব। আপনারাও সাথে যাবেন। এখন একটা মিসিং ডাইরি করে যান।
সারা রাত দুজনেই ঘুমাতে
পারলেন না। মাঝে মাঝেই বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসছে। পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ ওসি
এসে হাজির। চলুন আপনাদের ঐ বেয়াই অবনী বাবুর অনেক খবর পেয়েছি। দু বছর আগে সাড়ে দশ
কোটি টাকায় ওরা বাড়িটা কেনে। এখানকার দুটো ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতেও বেশ
কয়েক কোটি টাকা আছে। আপনার জামাইয়ের প্যান কার্ডও আছে। তবে জালও হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল
ক্রিমিনাল হলে সবই সম্ভব। কিন্তু হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার মোটিভটা স্পষ্ট নয়।
তালা ভেঙে বাড়িটাতে ঢোকা হল।
কিন্তু একেবারে ধোয়া পোঁছা। ওই বাড়িতে যে কেউ কোনোদিন বাস করেছে তার কোনো চিহ্ন
নেই। পৃথুর ঘরের সব কমপিউটার, সুইচের প্যানেল সব উধাও। ছাদের অ্যান্টেনাগুলিও নেই।
শুধু বাড়ির মাঝখানের চাতালে একটা বিশাল গর্ত। প্রায়
কুড়ি ফুট ব্যাস। গভীর প্রায় চল্লিশ ফুট। নীচে জল জমে আছে। পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে
গিয়েছে।
ওসি বললেন, কিছুই তো বোঝা
যাচ্ছে না। বাড়ির মাঝখানে এত বড় একটা জলের কুয়ো। এরা তো
দেখছি কোনো ক্লু রেখে যায়নি। ফরেনসিককে একবার খবর দিতে হবে। আর ওই গর্তটাও একটা
রহস্য।
অনীশ বললেন, এই কুয়োটা তো আগে
ছিলোনা।
ওসি শুনে বললেন মনে হয় কিছু
দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। কুয়োর ভিতরে লোক নামিয়ে দেখা যাক। যদি ডেডবডি পাওয়া যায়।
লোক নামিয়েও কিছুই উদ্ধার
হলনা। কয়েকটা ধাতুর টুকরো আর কিছু কলকব্জা পাওয়া গেল। দেখে মনে হয় গাড়ির পার্টস। ধাতুর টুকরোগুলো নেড়েচেড়ে ওসি বললেন, এগুলি
ফরেনসিকে পাঠাতে হবে।
আরো কয়েকদিন কেটে গেল। কোনো
খোঁজ পাওয়া গেল না। মানুষগুলি যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন থানায়
খবর করা হয়েছে। কেউ এদের দেখেনি। হাসপাতাল, স্টেশন, বিমান বন্দর কোথাও না।
দীর্ঘদিন ধরে লম্বা তদন্ত
চলল। কিন্তু ফলাফল একেবারে শূন্য। পুলিশ হতাশ হয়ে দু বছর পরে ফাইল বন্ধ করে রেখে
দিল।
অনীশবাবু এই ধাক্কায় অনেকটা
ভেঙে পড়লেন। লেকে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়াও একরকম বন্ধ করে
দিলেন। এর মধ্যে একদিন স্ত্রী ও মারা গেলেন। অনীশবাবু একেবারে একা হয়ে গেলেন।
এর প্রায় দশ বছর পরে একদিন
বিকেল বেলায় শুনতে পেলেন বাইরে রাস্তার থেকে কে যেন তাকে ডাকছে অনীশ কাকু, অনীশ
কাকু বলে। একটি মেয়ের কন্ঠস্বর। জানলা দিয়ে দেখলেন একটি মেয়ে, বসুধার
বন্ধু মন্দিরা। হাতে একটা কাগজ। খুব উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলতে চাইছে। অনীশ
তাকে উপরে আসতে বললেন।
মন্দিরারর মুখ চোখ উত্তেজনায়
লাল হয়ে আছে। হাতের কাগজটা অনীশের হাতে দিয়ে বলল, বসুধার একটা ইমেইল পেয়েছি। আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা,
কিন্তু আমার মেইলে পাঠিয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কী করে এলো
তাও বুঝতে পারছিনা। আপনি পড়ে দেখুন। আমি প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছি। সাথে একটা ছবিও আছে।
বসুধা লিখেছে:
মা ও বাবা, আমি যে তোমাদের
থেকে কত দূরে আছি তা মাইল, কিলোমিটার দিয়ে বোঝাতে পারব না। শুধু আলোকবর্ষ দিয়েই তা
মাপা যায়। পৃথিবী থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে ঠিক পৃথিবীর মত একটা সবুজ নীল গ্রহে
রয়েছি। এখানে বাড়ি ঘর শহর সব কিছু আছে, অনেক রকমের প্রাণি আছে, শুধু মানুষ নেই। মানুষ
বলতে আমরা তিনজন, যদি পৃথু আর তার বাবাকে মানুষ বলা যায়। ওরা এই গ্রহের বুদ্ধিমান
প্রাণি। একেবারে মানুষের মত। ওদের সব কিছু, এমনকি ডিএনএর গঠন পর্যন্ত আমাদের মত।
কিন্তু বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে মানুষের থেকে অনেক উন্নত। এরা বহু বছর আগে এখানে এক
বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু হঠাৎ এদের মেয়েদের মধ্যে একটা জেনেটিক পরিবর্তন
আসে। ফলে মেয়েরা আর সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আস্তে আস্তে এদের জনসংখ্যা কমে
যেতে থাকে। অবশেষে তা শূন্যে নেমে যায়। তাই প্রায় তিন দশক আগে পৃথু আর তার বাবা
মহাকাশে বেরিয়ে পড়ে যদি অন্য কোনো গ্রহে তাদের মত প্রাণি থাকে তবে তাদের কোনো
নারীর সাহায্যে তাদের হারিয়ে যাওয়া সমাজ
নতুন করে তৈরি করতে পারবে।
অনেক নক্ষত্রলোক ঘুরে তারা
পৃথিবীতে এসে মানুষের সন্ধান পায়। পৃথিবীর মানুষ সব দিক দিয়ে একেবারে তাদের মত।
কলকাতায় বসে তারা খুঁজতে থাকে তাদের উপযুক্ত কনে।
তোমার মনে আছে সেই চায়ের
নিমন্ত্রণের কথা। সেদিন ওরা চায়ের কাপে লেগে থাকা আমাদের লালা পরীক্ষা করে দেখেছিল
আমাদের ম্যাচ হতে পারে কিনা। ওরা পৃথিবীর আরো অনেক মেয়েকে এই ভাবে পরীক্ষা করেছে।
কিন্তু আমাকেই ওরা সবথেকে উপযুক্ত মনে করেছে।
বাড়ির মাঝখানে একটা গর্তে
ওদের মহাকাশযান লুকানো থাকত। প্রথমে তাতে চড়ে আমরা চাঁদের কাছাকাছি এক বিশাল
আন্তর্নক্ষত্র মহাকাশযানে আসি। তারপর চার বছর ধরে আলোর গতিতে যাত্রা করে এই গ্রহে
এলাম।
ওদের এক্সপেরিমেন্ট সফল
হয়েছে। আমাদের প্রথম সন্তানের ছবি পাঠালাম, ঋদ্ধি আমার কন্যা। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে
জন্মেছে। পৃথু আর আমি এই গ্রহের নতুন আদম আর ইভ।
এখানে যান্ত্রিক ব্যবস্থা খুব
উন্নত। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থাও পৃথু করে দিয়েছে। আর
তাইতো তোমাকে এই চিঠি পাঠাতে পারছি।
বাবা, তোমার থেকে চার
আলোকবর্ষ দূরে বসে তোমার মেয়ে একটা নতুন মানব সমাজের জন্ম দিচ্ছে। এতে তোমার গর্ব
হবে না দুঃখ হবে, বুঝতে পারছিনা। চার বছর পরে তুমি এই চিঠি হাতে পাবে। পাবে কিনা তাও জানিনা।
ভালো থেকো
বাবা, মা।
অনীশবাবু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত
হয়ে বসে রইলেন। তারপর জামাকাপড় পরে তৈরি হলেন থানায় এই খবরটা জানানোর জন্য। সিঁড়ি
দিয়ে কয়েক পা নেমেই আবার উঠে এলেন। থানায় জানিয়ে কী হবে? ওরা এসব কথা
বিশ্বাসই করবে না।
মন্দিরার দিকে ফিরে বললেন,
আমার জন্য একটা কম্পিটারের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস মা? আর ই মেইল করাটাও শিখিয়ে
দিবি। এই চিঠির একটা উত্তর দিতে হবে।
(কল্পবিশ্বের লিঙ্কঃ আদম ইভের প্রত্যাবর্তন )