এটা সর্বৈব সত্যি ঘটনা। আমার বড়পিসিমার মুখে শোনা।
১৯৪৭ সাল। আমার বড় পিসেমশাই তখন পূর্ববঙ্গে একটা রেল স্টেশনে পোস্টেড। পিসেমশাই রেলের ডাক্তার ছিলেন। ক্যাম্বেল থেকে এলেমেফ পাশ করে রেলের চাকরীতে যোগ দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের যে স্টেশনে ছিলেন ভারত ভাগের দাঙ্গার আঁচ সেখানেও পড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগেও কিছু লোক তাদেরকে দেশ ছাড়তে বলে গিয়েছে। ডাক্তার বলে তখন পর্যন্ত গায়ে হাত পড়েনি। কিন্তু বেশিদিন থাকা যাবেনা সেটা পিশেমশাই বুঝে গিয়েছেন। পিশেমশাইও ঠিক করলেন কলকাতায় চলে যাবেন। যেতে হলে ট্রেনে যেতে হবে, পথে জায়গায় জায়গায় দাঙ্গা হচ্ছে।
যদি কোনো বিপদ হয় সেই ভেবে একটা প্ল্যান আঁটলেন। ঠিক করলেন মুসলমানের ছদ্মবেশে এখান থেকে যাবেন। সেই ভেবে দাড়ি রাখলেন, জলকে পানি বলা শুরু করলেন। চেক চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী কিনে আনলেন। পিসিমাও সিঁদুর মুছে হাতের নোয়া শাখা খুলে কাঁচের চুড়ি পরে নিলেন। মুসলমান মেয়েদের মত ঘোমটা দেওয়া অভ্যাস করলেন। কয়েকদিন পর আয়নায় নিজেদের চেহার দেখে বুঝলেন ছদ্মবেশ সম্পূর্ণ।
একদিন শুভক্ষণ দেখে শিয়ালদাগামী ট্রেনে উঠে বসলেন দুজনে। তাদের দেখে আর হিন্দু বলে বোঝার উপায় নেই। ট্রেনে বিশেষ ভীড় ছিলনা। বর্ডার পার হতেই দেখলেন ট্রেনের কামরায় তারা দুজন বাদে আর যাত্রী নেই। ট্রেন একসময় সন্ধ্যা নাগাদ শিয়ালদা স্টেশনে এসে ঢুকল। পিশেমশাই ভেবেছিলেন একবার হিন্দুস্থানে ঢুকে পড়তে পারলে আর পায় কে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল অন্য রকম। শিয়ালদা স্টেশনে তখন উদ্বাস্তুদের ভীড়। তারা যত্র তত্র ছড়িয়ে বসে আছে। পিসিমা পিশেমশাই নামতেই তারা ঘিরে ধরে কীল, চড় ঘুষি মারতে শুরু করল। তারা পোষাক দেখে ভেবেছে এরা দুজন মুসলমান। পিসেমশাই ভেবেছিলেন একবার ইন্ডিয়ায় ঢুকতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু তার জন্য যে ছদ্মবেশ ছাড়তে হবে সে কথা মনেই আসেনি।
যাই হোক প্রচন্ড মার খেয়ে তারা যখন প্ল্যাটফর্মে লুটোপুটি খাচ্ছেন তখন রেলের এক ড্রাইভার তাদেরকে চিনতে পেরে জনতাকে থামায়। তারপর সবাই মিলে রেলের হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি করে দেয়। কুড়ি বাইশদিন হাসপাতালে কাটানোর পর পিশেমশাইয়ের একটা উপলব্ধি হয়েছিল। বলতেন, অত ধর্ম ধর্ম করিসনা। গায়ের এই পোষাকটাই হইল গিয়া ধর্ম। আর কিছু না।
No comments:
Post a Comment