বীজপত্র
(গল্প)
সুমন ছোটবেলায় খুব ভালোবাসতো বীজের
ভিতর থেকে ছোট্ট চারা বের হওয়া দেখতে। ছোলা বা মটরের বীজ থেকে যখন ছোট্ট অঙ্কুর
মাথা তুলত ও অবাক হয়ে যেতো। প্রশ্ন করতো, এই ছোট্ট ছোলা থেকে অতবড় গাছ হবে? একটু
বড় হয়র যখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ছে তখন বায়োলজি বই থেকে একটা কথা শিখেছিল,
বীজপত্র। বীজ থেকে যখন অঙ্কুর বের হয় তখন প্রথমে সে শিকড় বার করে। সেই শিকড় যখন
মাটির ভিতরে তার ভিত পেয়ে যায় তখনই বীজপত্র ফাঁক হয়ে ছোট্ট শিশু গাছ মাথা তোলে।
শিকড় মাটি না পেলে ওই বীজপত্রের আড়ালেই ঘুমিয়ে থাকে গাছের ভবিষ্যৎ। অপর্ণা সুমনকে
ছোটবেলায় শিখিয়েছিলো সেই বিখ্যাত কবিতা," ইন দা হার্ট অফ এ সিড, বারিড ডিপ সো
ডিপ এ ডিয়ার লিটল প্ল্যান্ট লে ফাস্ট অ্যাস্লিপ....।" সুমন বাগানে কোনও গাছের
অঙ্কুর বের হতে দেখলেই কবিতাটা আবৃত্তি করত। সুমন তখন খুব ছোট ছিল। সুমন এখন অনেক
বড় কলেজে পড়ে।
অপর্ণা বাড়ি ছিলোনা। কিছু
দূরে এক ছাত্রীর বাড়িতে গান শেখাতে গিয়েছিলো। নতুন পাড়ায় আসার পর বেশ কয়েকজন
ছাত্রী জুটে গিয়েছে। সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীতই শেখে। অপর্ণার ক্লাসিকাল গানের ভিত তত
জোরদার নয়। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত সে শিখেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত সে জানে। দীর্ঘদিনের
সাধনায় নিজের জন্য এই একটা জায়গা সে করে নিতে পেরেছে। এই জানাটা অবশ্যই ঘটেছে
গুরুর কৃপায়। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। যখন ছোট ছিল তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত
শুনতে ও গাইতে ভালোবাসত। তারপর নিতমিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নিয়েছে। আজ যখন সে
গান গাইতে বসে প্রতিটি গানকেই নতুন করে আবিষ্কার করে। মনে হয়ে প্রতিটি
রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন প্রতিদিন নতুন করে লেখা হচ্ছে তার জন্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত অপর্ণার
প্রতিদিনের বেঁচে থাকার রসদ নিয়ে আসে পরিপূর্ণভাবে।
অপর্ণা বাড়ি ফিরে দেখল সুমনের
ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। গীটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাইছে কোনো এক রক ব্যান্ডের ইংরাজি
গান। এসব গানের সাথে অপর্ণা এখনো সমঝোতা করে উঠতে পারেনি। গানের কথা ও সুর সময় সময়
অসহ্য মনে হয়। কী করে যে ছেলেটা এসবের ভক্ত হল। অথচ ছোটবেলায় অনেক যত্ন করে গান
শেখানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে অন্ততঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত ওর হৃদয়ের গভীরে ঢুকে
যাক। এ যে কি বিপুল সম্পদ আজ এই মধ্য বয়সে এসে অপর্ণ উপলব্ধি করতে পারছে। সেই
উপলব্ধির কিছুটা অন্ততঃ ওর অন্তরেও ঘটুক। গলায় সুর আছে ছেলেটার। সেটা কেউ অস্বীকার
করতে পারবেনা। খুব ছোটবেলায় যখন সরু গলায় গাইতো দূর দেশী কোন রাখাল ছেলে তখনই সুরে
ভরে যেত চারধার। তারপর অপর্ণা কিছুদিন চেষ্টা করেছে কোনো বড় গায়কের কাছে গান
শেখানোর। ল্কিন্তু দেখা গেল্ধারাবাহিকভাবে গান শিখতে তার ঘোরতর আপত্তি। বলে মা
তোমার কাছে ছাড়া আর কারো কাছে গান শিখব না। কিন্তু তাই বা শিখল কই?
কলেজে ঢুকেই কেমন যেন পালটে
গেল ছেলেটা। বাংলা গান তো গাইতে বসেইনা, শুধু টিভি দেখে। সারাক্ষণ চ্যানেল
ঘোরাচ্ছে আর আর এমটিভি বা ভিটিভ দেখছে। যখন টিভি দেখছেনা তখন দেখা যাচ্ছে কমপিউটার
নিয়ে বসে ভিডিও গেম খেলছে। ওই সব বিদেশী গানে যে কী রস আছে অপর্ণার মাথায় ঢোকেনা।
অপর্ণা আগে প্রতিবাদ করত, বলত, তুই তোর এত সুন্দর গলা নষ্ট করে ফেললি। আর এই সব
গানের মধ্যে কী আছে? এগুলো কি আমাদের গান?
সুমন তেড়িয়া হয়ে জবাব দিতো,
এগুলো তোমাদের গান নয়, আমাদের গান। আমাদের বয়সে এখন এসব গানই চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত
এখন অচল। বুড়োটে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেই মাথা ধরে যায়।
অপর্ণা বলে কিন্তু এই গান
আমাদের প্রাণের সম্পদ। আমাদের মনের সব কথা এতে রয়েছে। ইংরাজি গান ভালো লাগে বলে
তুই আমাদের যেটা রুট, আমাদের শেকড়, সব ভুলে যাবি?
এই রুট দিয়ে কী হবে? তোমরাই
তো চাওনা আমরা রুট ধরে বসে থাকি। তুমি চাও আমি জি আরই দিয়ে আমারিকায় চলে যাই।
সেখানে গেলে তোমার ওই রবীন্দ্রসঙ্গীত কে শুনবে বল? বাংলা গানের কোনো দাম নেই। আমরা
যা শুনি তা গ্লোবাল সং।
অপর্ণার মাথায় ঢোকেনা কেন
সবকিছু পালটে গেল। এই ছেলেই এক সময়ে বায়না ধরে কঠিন কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে
নিয়েছে তার কাছ থেকে। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত তখনই চাইতো ধ্রুপদ অঙ্গের গান তুলতে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন রাগ চেনা হয়ে গিয়েছিল তার। তারপর যেদিন
বয়ঃসন্ধিতে গলা ভাঙতে শুরু করল সেদিন কী দুঃখ। বার বার বলত, মা আমার গলা আর ঠিক
হবেনা? আমি আর গান করতে পারবনা?
অপর্ণা বলত কেন পারবিনা? সব
ছেলেদেরই এই বয়সে গলা ভাঙে। দেখবি একটু বড় হলেই আবার গলায় সুর ফিরে আসবে। গান
গাইতে পারছেনা দেখে অপর্ণা একটা গীটার কিনে দিয়েছিল। স্প্যানিশ গীটার। সুরের
তীক্ষ্ণ বোধ থাকায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সেটা রপ্ত করে ফেলল। তারপর গলাও একদিন
ঠিক হল। কিন্তু কী করে যেন ধীরে ধীরে গানের অভিমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে ঘুরে
ইংরাজি পপ গানের দিকে চলে গেল।
কথা বললেই আজকাল তর্ক শুরু
হয়ে যায়। তাই অপর্ণা আর কিছু বলেনা। নিজে একা একাই গান গায়। গীতবিতানের পাতার
ভিতরে আলাদা একটা মুক্তির জগত আছে তা সে প্রতিদিনই উপলব্ধি করে। আর মনে মনে হায়
হায় করে, ছেলেটা এই সুধারসের থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছে।
আজও সুমন ঘুম থেকে উঠেছে
কিছুক্ষণ আগে। তারপরেই গীটার নিয়ে বসে গেছে। অপর্ণা জানে এখন কিছু বলেই লাভ নেই।
যখন মনে হবে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে খেতে চাইবে। এখন মার সাথে এই একটাই সম্পর্ক
রয়েছে। সকাল বেলাতেই এই বিদেশী সুরে গীটারের শব্দ অপর্ণা সহ্য করতে পারেনা। নিজের
ঘরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নীল আকাশ, শীতে নিষ্পত্র একটা
শিমুল গাছ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
দুপুর বেলায় হঠাৎ ফোন বেজে
উঠল। ওদিক থেকে নবনীতা ফোন করেছে, অপর্ণা, বৌদি এই একটু আগে হঠাৎ চলে গেলেন।
ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার এসেছিল, কিন্তু কিছুই করা গেলনা। আমরা সুবিনয়দার
বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যাবে তো আমাদের বাড়ি চলে এসো এখনই।
বৌদি আর নেই ভাবতে ভীষণ কষ্ট
হল অপর্ণার। বলল, সুবিনয়দা তো এখন নার্সিং
হোমে। বৌদির ওখান থেকে ফেরার পথে সুবিনয়দাকে একবার দেখে আসব।
সুবিনয়দা চলে গেলেন ঠিক তিন
দিন পরে। নার্সিং হোমেই। খবর পেয়েই অপর্ণা ছুটল। তখন দুপুর বেলা। সুমন কলেজ থেকে
ফেরেনি। একটা চিরকুটে লিখল, সুবিনয়দা মারা
গেছেন। আমি যাচ্ছি। চাবি উপরতলায় রইল। খেয়ে নিও।
সুবিনয়দার বাড়ি লোকের ভীড়ে
অপর্ণা কাছে যেতেই পারলনা। কিছুক্ষণ আগেই শবদেহ নার্সিং হোম থেকে আনা হয়েছে।
সাংবাদিক, সেলিব্রিটি, ভি আই পি দের ভীড়ে, ফুলের মালার স্তুপের ভিতর দিয়ে
সুবিনয়দাকে আর দেখাই যাচ্ছেনা। অপর্ণার দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। সুবিনয়দা শুধু
গুরু ছিলেননা, ওঁর কাছে বসে গান শেখা ছিল এক ঈশ্বরবন্দনার মত অনুভব। পঁচিশ বছর ধরে
ওঁর কাছে গান শিখেছে। কত গান যে তিনি শিখিয়েছেন তার শেষ নেই। শেষের দিকে চোখে ভালো
দেখতে পেতেন না। কিন্তু তখন তাঁর গান যেন হয়ে উঠত কোন গভীর অন্তর থেকে উঠে আসা
অমৃতবর্ষণের মত মধুময়। প্রতিটি ক্লাসেই উনি ওদের হাত ধরে স্বর্গের কাছাকাছি এক
বাগানে পৌঁছে দিয়েছেন।
সরকারি ব্যবস্থাপনায়
ইতিমধ্যেই শবযাত্রার তোড়জোর শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশের পাইলট ভ্যান এসে গিয়েছে।
কীভাবে কোন রাস্তায় সুবিনয়দাকে নিয়ে যাওয়া হবে তাই নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অফিসার কার
সাথে যেন কথা বলছে। নবনীতা ধরা গলায় বলল, শোনো অপর্ণা আমরা কিন্তু রবীন্দ্রসদন
পর্যন্ত যাব। অপর্ণা উত্তর দিলনা। কোথায় যেন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু
ঠিক কোথায় এই শূণ্যতা তা ঠিক ধরতে পারছেনা। এই শূণ্যতা কি গানের জগতে, নাকি তার
মনের মধ্যে সেটাই অপর্ণা খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
সামনে হুটার লাগানো পুলিশের
গাড়ি, তারপর সুবিনয়দার মরদেহ নিয়ে গাড়ি। তারপরেই নবনীতার ড্রাইভার কায়দা করে নিজের
গাড়িটা মিছিলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। অপর্ণা তাকিয়ে দেখল কোন মন্ত্রবলে বাইপাসের
সমস্ত গাড়ি স্তব্ধ অচল হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো লাল বাতি নেই। রাস্তাড় মোড়ে মড়ে
পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি। পরমার মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে এগিয়ে চলল শবযাত্রা। পার্ক
সার্কাসের মুখে সব গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সুবিনয়দাকে পথ ছেড়ে দেওয়ার
জন্যই।
পার্ক সার্কাস থেকে
রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত নতুন ফ্লাইওভারটা খুলে দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। অপর্ণা
এখন পর্যন্ত ওটার উপর দিয়ে যায়নি। লম্বা সেতুটার উপরে আজ একটাও গাড়ি নেই। শূণ্যের
মধ্যে লম্বা হয়ে সেতুটা শুয়ে আছে। খোলা রাস্তা পেয়ে পুলিশের গাড়ি আর সুবিনয়দার
মরদেহ নিয়ে গাড়ীটা কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার অপর প্রান্তে অপর্ণার মনে হল, এটাই
যেন সেই অনন্তের রাতা যে পথে চললে এক অবিনশ্বর আনন্দলোকে পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে হল,
এই পথে সুবিনয়দাকে নিয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে শূণ্যে মিলিয়ে যাবে।
রবীন্দ্রসদনে ভীড় উপচে পড়ছে।
মুখ্যমন্ত্রী এলেন ফুলের মালা নিয়ে। আরো কয়েকজন মন্ত্রী সরকারী আমলা এসে ফুলের
মালা দিয়ে গেল। অপর্ণা আর নবনীতা কুন্ঠিত মুখে নন্দনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল
কিছুক্ষণ। অপর্ণা নবনীতাকে বলল, আজ আর সুবিনয়দা আমাদের নন। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে
কী হবে। বাড়ি যাই।
নবনীতা অপর্ণাকে কালীঘাট
পার্কের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। একটু এগিয়ে রাসবিহারী মোড়ের কাছে অটো পেয়ে গেল
অপর্ণা। সুবনয়দা যে আর বাঁচবেননা এবার নার্সিং হোমে যাওয়ার সময়ই সেটা বোঝা
গিয়েছিল। এতবড় গায়ক, এতবড় একজন শিক্ষক চলে যাওয়া গানের জগতে এক বিরাট শূণ্যতা যে
এনে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। ওঁর জায়গা আর কেউ নিতে পারবেনা। শেষ ক্লাসে সুবিনয়দা
শিখিয়েছিলেন, অনন্তের বাণী তুমি বসন্তের মাধুরী উৎসবে। এই গানের কটা লাইন কেবল
মাতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছেনা। অপর্ণার এই দুঃখের ভার
নেওয়ার মত কেউ নেই বাড়িতে।
অটো থেকে নেমে গলির মুখে
দাঁড়িয়ে মনে হল, সুমন এতক্ষণে নিশ্চয়ই কলেজ থেকে ফিরেছে। একবার ভাবল, ওর জন্য কিছু
খাবার কিনে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ভাবল, থাক, এই একটা দিন অন্ততঃ ও নিজের ব্যবস্থা
করে নিক।
বাড়ির কাছে এসে দরজায় বেল বাজাতে গিয়ে অপর্ণা
থমকে দাঁড়ালো।। আজ ভিতর থেকে গীটারের আওয়াজ আসছেনা। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুমন একা
গান গাইছে, আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো...। হাল্কা
বাতাসে গাছের শাখার দোলনের মত গানের মীড়গুলো স্পষ্ট হয়ে বাজছে সুমনের গলায়।
শ্যামলী দরজা না খুলে সিঁড়ির
উপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। না শেকড় হারিয়ে যায়নি। মাটিতেই রয়েছে। বীজপত্র ফাঁক করে
ধীরে ধীরে নতুন পাতা মাথা তুলছে।
No comments:
Post a Comment