প্রথমেই বলে রাখি, যদিও এটি সত্যি ঘটনা তবুও কোথাও কোথাও স্মৃতি আমার সাথে
চাতুরী করে থাকতে পারে। তবে এই কাহিনির পাত্রপাত্রীরা অনেকেই সশরীর বর্তমান। ভুলভ্রান্তি
তাঁরাই শুধরে দেবেন।
হোমিওপ্যাথিতে আমার আগ্রহ অনেক দিনের। ছোটবেলা থেকে হেঁপোরুগি বলে নানা
রকম চিকিৎসার সাথে সাথে হোমিওপ্যাথি ওষুধও খেতে হয়েছে বিস্তর। তার উপরে ডাক্তার হওয়ার
শখও ছিল। মেডিকাল কলেজে পড়ার সুযোগ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে অনেকদিনই। ভাবলাম একটু বই
টই পড়ে হোমিওপ্যাথি শিখে রাখব। আখেরে কাজেও লাগতে পারে। বাহাত্তর সাল নাগাদ ডাক্তার
হওয়ার একটা সুযোগ এলো।
তখন এমএসসি পাশ করে বেকার বসে আছি। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে গিয়ে রিসার্চের
নামে আড্ডা মারি। সেই সময় এক ভূতাত্বিক দাদা কলেজে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্লাইড জিওলজি
পড়তে এলো। দাদার বয়স তখন ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে। বিবাহিত। সেই দাদাকে দেখলাম নামের আগে
ডক্টর লিখছে। আর একদিন দেখলাম কলেজের একটি মেয়েকে পাশে বসিয়ে প্যাড খুলে খসখস করে প্রেস্ক্রিপশন
লিখছে। আমি তো অবাক। দাদা আমাকে পাশে বসিয়ে বলল, “আমি একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। দরকার
হলে বোলো”।
বললাম, “তুমি ডাক্তারি পড়লে কবে? আর ডাক্তার হলেই বা কবে?”
দাদা বলল, “আমি ডাক্তারি পড়িনি। আমি আরএমপি মানে রেজিস্টার্ড মেডিকাল প্র্যাকটিশনার।একটা
চান্স পেলাম, নিয়ে নিয়েছি। হোমিওপ্যাথি মেডিকাল কাউন্সিল একটা নিয়ম করেছে, যারা পাশ
না করেও অনেকদিন ধরে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করছে তাদেরকে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দিচ্ছে।
তার জন্য অবশ্য কিছু নিয়ম কানুন আছে, কয়েকজন ডাক্তারের রেকমেন্ডেশন চাই, প্র্যাকটিসের
প্রমাণ চাই, ইত্যাদি। আমি সেসব জোগাড় করে অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিলাম। আমার রেজিস্ট্রেশন
হয়ে গেছে। তুমি চাইলে তোমারটাও করিয়ে দিতে পারি”।
আমি বললাম, “কী করে?”
দাদা বলল, “সে আমি ব্যবস্থা করে দেবো”।
আমি দাদার সাথে কয়েকদিন নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করলাম। কাউন্সিলেও গেলাম।
কিন্তু হলনা। আসলে বয়সটাই সমস্যা হল। দশ বছর প্র্যাকটিস করেছি এটা প্রমাণ করতে পারলামনা।
কারণ দশ বছর আগে আমি নিতান্তই নাবালক ছিলাম। কাউন্সিল ঐ স্কিমটা সাময়িকভাবে চালু করেছিলো।
পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সেবারের মত ডাক্তার হওয়া হলনা।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। ১৯৮৪ সালে চাকরী সূত্রে বদলী হয়ে এলাম জলপাইগুড়িতে।
জলপাইগুড়িতে সময় কাটানোর জন্য সন্ধ্যাবেলায় বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে বসতাম। পাঠাগারের
পাশেই একদিন দেখলাম এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার। গিয়ে দেখি আমার স্কুলের বন্ধু
মানস সেখানে বসে প্র্যাকটিস করছে। ভালোই হল, আমার একটা আড্ডা মারার জায়গা হল। মানস
অবশ্য কোয়াক প্র্যাকটিস করা “আরএমপি” নয়। রীতিমত পাশ করা ডাক্তার। জলপাইগুড়িতে ছাড়াও
শিলিগুড়িতে চেম্বার আছে। কোট-টাই পরে প্র্যাকটিস করে।
একদিন মানস আমাকে বলল, “জলপাইগুড়িতে একটা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ খুলসি। চল তোকে দেখাতে নিয়া যাব”।
জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়ায় বৌবাজারের পাশে বিরাট একটা মাঠ ছিল। সেখানে অনেকটা
জায়গা নিয়ে হোমিওপ্যাথি কলেজের বাড়ি উঠেছে। বাংলা প্যাটার্ণের বাড়ি। লম্বা টানা বারান্দা।
হাসপাতালের ওয়ার্ড, ক্লাস রুম, অফিস, সব কিছু নিয়ে খুব ছিমছাম চেহারা। সবুজ রঙের টিনের
চাল, দেয়ালের অর্ধেক সিমেন্টের গাঁথনি, বাকিটা বেড়ার দেওয়াল। দুটো ওয়ার্ডে গোটা কুড়ি
বেড, আবার একটা শিশুদের ওয়ার্ডও আছে। গোটা তিনেক ক্লাসরুম, ল্যাবরেটারি সবই তৈরি হয়েছে।
সব মিলিয়ে অনেকটা সেনাবাহিনীর ফিল্ড অফিসের মত দেখতে। মানস খুব খাতির করে আমাকে প্রিন্সিপালের
চেম্বারে নিয়ে বসালো।
মানসের সাথে সাথে কয়েকজন ছেলেও এসে ঢুকল চেম্বারে। মানস আমার সাথে আলাপ
করিয়ে দিল। এরা সবাই মেডিকাল এর ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ারের । মানস বলল, “বুঝলি উত্তরবঙ্গে
এইটাই প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেডিকাল কলেজ হবে। আমি একটা কমিটি করসি। তাতে সরকারি আমলা
থেকে এমএলএ, এমপিদেরকেও রাখসি। টাকা পয়সা ভালই উঠতাসে। অভাব হবেনা”।
আমার ভালই লাগল। আমাদের একজন বন্ধু এত বড় একটা কাজ হাতে নিয়েছে। আমি মনে
মনে বেশ একটু ইনভলভড হয়ে গেলাম। এইভাবে দিন কাটে। সন্ধ্যা বেলায় মানসের চেম্বারে গিয়ে
বসি। মানসের ছাত্ররাও দু একজন এসে বসে। মানস তাদের সাথে রোগের উপসর্গ, ওষুধ, পোটেন্সি,
এসব নিয়ে আলোচনা করে। এসব দেখতে দেখতে আমার ডাক্তার হওয়ার বাসনাটা আবার চাগিয়ে উঠল।
একদিন মানসকে বলেই ফেললাম, “দ্যাখ আমি যদি তোর কলেজে ভর্তি হই তা হলে কেমন
হয়? আমাকে অবশ্য অফিস থেকে পারমিশন নিতে হবে। তা সে আমি জোগাড় করে নেবো”।
মানস বলল, “তুই তো ভালই চাকরি করতাসিস। আবার ছাত্র হবি ক্যান। তুই বরং ফ্যাকাল্টি
হয়ে যা”।
শুনে তো আমি হাঁ। “ফ্যালাল্টি হব কিরে? আমি ডাক্তারির কি জানি? মেটিরিয়া
মেডিকা একটু নাড়াচাড়া করেছি। তার বেশি তো কিছু জানিনা”।
মানস বলল, “তুই তো জিওলজি পড়সিস, তাতে বায়োলজি পড়তে হয়না?”
আমি বললাম, “হয়, কিন্তু সে তো প্যালিওবায়োলজি। ফসিলের ব্যাপার”।
মানস বলল, “ওতেই হবে, তোকে একটা ফিজিওলজি বই দিতাসি। পড়ে নিস। তুই পড়াবি”।
বইটা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। নিরস বই। মানসের অনুরোধে সত্যিই একদিন ক্লাস
নিলাম। ক্লাস নিয়েই বুঝলাম এটা আমার কাজ না। তবে ছাত্ররাও দেখলাম খুব ভালো। একটাও প্রশ্ন
করলনা।
এর মধ্যে কলেজের প্যাথোলজি ল্যাবের কিছু যন্ত্রপাতি এসে গেল। সকালে ওপিডি
চালু হয়ে গেল। পান্ডাপাড়া কলোনি, ও আশেপাশের গ্রাম থেকে রুগিও আসতে শুরু করল। সকাল
বেলায় মানস এবং আরো দুজন ডাক্তার এসে ওপিডি সামলায়। ছাত্ররা ওপিডিতে বসে রেপার্টারি
বানায়। দু তিনজন ছাত্রের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। এর মধ্যে জলপাইগুড়ি সায়েন্স ক্লাবের
সাথে খুব জড়িয়ে পড়লাম। এই হোমিওপ্যাথির দু একজন ছাত্রও আমাদের ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়ে
পড়ল।
একদিন মানস বলল, “কলেজের সাথে একটা ব্লাড ব্যাঙ্ক খুলতে হবে। তার জন্য টাকা
চাই। চাঁদা তুলতে হবে। পুরো উত্তরবংগ ঘুরে স্কুলে স্কুলে চাঁদা তুলব। তুইও সাথে চল”।
আমি বললাম “আমার এমাসে ফিল্ডওয়ার্ক আছে। এই সাথে আমি ফিল্ডওয়ার্কটাও সেরে
নেবো। আমার সাথে ঘুরলে তোদের খরচ কিছুটা বেঁচে যাবে”।
কয়েকদিন ধরে মানস ও তার দুজন ছাত্রকে নিয়ে জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলার নানা
জায়গা ঘুরলাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে চাঁদা তুলে দিলো। ঘুরে এসে দেখলাম হাজার পাঁচেক টাকা
জমা হয়েছে। মানস বলল, এতে হবেনা, আরো কয়েক জায়গায় ড্রাইভ দিতে হবে।
কলেজের কাজকর্ম ভালই এগোচ্ছিলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো কলেজের এফিলিয়েশন
নিয়ে। এফিলিয়েশন না হলে কলেজের কোনো দাম নেই। ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে পারবেনা। ডিগ্রিও
পাবেনা। হোমিওপাথি কাউন্সিলের কাছে আগেই আবেদন জমা দেওয়া হয়েছিলো। মানস কলকাতায় গিয়ে
নিয়মিত তদবির চালাচ্ছিল। অবশেষে শোনা গেল কলকাতা থেকে একটা টিম কলেজ পরিদর্শনে আসবে।
পরিদর্শনের কয়েকদিন আগে থেকে মানস হাসপাতালে কয়েকজন রুগি ভর্তি করে নিলো।
কয়েকজন ডাক্তারকেও রাজি করালো ওদিন হাজির থাকার জন্য। দু একজন সরকারি অফিসার, পঞ্চায়েতের
সদস্য, এদেরকেও হাজির থাকতে বলল। আমিও আমন্ত্রিত হলাম। কলকাতা থেকে কাউন্সিলের তিনজন
প্রতিনিধি এলেন। বেশ রাশভারি লোকজন। আমার সাথেও তাঁরা আলাপ করলেন।
দুতিন দিন তাঁরা জলপাইগুড়িতে থেকে, বেড়িয়ে টেড়িয়ে ফিরে গেলেন। আমাদের সংগ্রহ
করা ব্লাডব্যাংকের টাকা খরচ হয়ে গেলো। কিন্তু কলেজটা কাউন্সিলের অ্যাফিলিয়েশন পেলো
না। এর মধ্যে বছর ঘুরে গেছে। জনা কুড়ি ছাত্র দু বছর ধরে মাইনে দিচ্ছে। হয়তো ক্যপিটেশন
ফিও দিয়েছে। এসব এতদিন চলেছে স্রেফ মানসের গুডউইলে। এবার আসল সমস্যা শুরু হল।
ছাত্ররা দেখল তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এখানে পড়ে থেকে লাভ নেই। আবার ছেড়ে
যেতেও পারছেনা। অনেক টাকা দিয়ে ফেলেছে। তখন সবাই মানসকে ধরে পড়ল কিছু একটা বিহিত করার
জন্য। এটা জলপাইগুড়ি না হয়ে অন্য শহর হলে এতদিনে কলেজে আগুন ধরিয়ে দিতো। জলপাইগুড়ির
মানুষরা একটু ঢিলাঢালা গোছের হওয়াতে পরিস্থিতি ভায়োলেন্ট হলনা। এদিকে মানস নিজেও খুব
চিন্তায় পড়ে গেল। এতগুলি ছেলেকে আশা দিয়ে তাদেরকে নিরাশ করে সে নিজেও হাত ধুয়ে ফেলতে
চাইলনা।
সে সময় দেশজুড়ে একটা বিশেষ প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তা হল সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন
করে মেডিকাল কাউন্সিল গঠন করা। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি
বা আয়ুর্বেদ ইউনানি ছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে।
সেগুলি আমাদের দেশে স্বীকৃত নয়। কিন্তু সেই সব চিকিৎসা পদ্ধতির লিটারেচার আছে, সম্ভবতঃ
গবেষণা পত্রও প্রকাশিত হয়। কিছু বুদ্ধিমান মানুষ সেগুলির উপর ভিত্তি করে একটা করে বিকল্প
চিকিৎসা পদ্ধতির কাউন্সিল বানিয়ে ফেলল। এগুলি সব সোসাইটির অ্যাক্টে রেজিস্টার্ড এবং
এদের মেমোরান্ডামে চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার একটা ক্লজ ঢোকানো আছে। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে,
বিহারে, মধ্যপ্রদেশে, আসামে এক একটি কাউন্সিল গজিয়ে উঠল। উদাহরণ হিসাবে এই চিকিৎসা
ব্যবস্থাগুলির নাম বলছি: ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথি, ব্যাচ ফ্লাওয়ার রেমিডি, ইত্যাদি।
মানস দেখল এই কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে যদি এই ছাত্রদের আরএমপি দেওয়ার ব্যবস্থা
করা যায় তা হলে আপাততঃ এই শঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে। মানস ছাত্রদের জানিয়ে দিল যে তারা
যদি এই বিকল্প চিকিৎসায় আরএমপি হতে চায় তাহলে মানস তার ব্যবস্থা করে দেবে। এটা পেলে
তারা আইনসঙ্গতভাবেই চিকিৎসা করতে পারবে, কিন্তু রুগিকে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে
পারবেনা। ছাত্ররা দেখল এটা মন্দের ভালো। চিকিৎসা করে উপার্জন করতে পারলেই হল।
দেখা গেল বেশ কিছু ছাত্র এতে রাজি। মানস এই ছাত্রদের স্বার্থে নিজে ইলেক্ট্রো
হোমিওপ্যাথি শিখে এই পদ্ধতিতেই চিকিৎসা শুরু করল। একই সাথে নিজের চেম্বারে ছাত্রদের
ক্লাস নিতে শুরু করল। অজানা ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথিতে রুগিদের আগ্রহ হওয়ার কথা নয়। তাই
মানস নিজেই রোগিদের কাছে গিয়ে হানা দিতে শুরু করল এবং চিকিৎসা করতে শুরু করল। দু একটি
ক্ষেত্রে সফলতাও পেলো।
এইভাবে কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পরে মানস ঘোষণা করল, “অল্টারনেটিভ কাউন্সিল
পরীক্ষা নিতে রাজি হয়েছে”। এই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলে সবাই আরএমপি পেয়ে যাবে। তা হলে
নিজের নিজের চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করতে পারবে। মানস আমাকে বলল, “তুইও পরীক্ষায় বস
গিয়া যা”। (ক্রমশঃ)
আমার খুব সন্দেহ ছিল যে এই সব কাউন্সিলের আরএমপি কতটা আইনসম্মত। মানস আমাকে
বোঝালো এগুলি নাকি সংবিধানের ১৯ নম্বর ও ২১ নম্বর আর্টিকেল সম্মত। এই সব কাউন্সিলের
বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে কেস হয়েছে। কিন্তু মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট একটা স্টে
অর্ডার দিয়েছে। ফলে এরা নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি এই সব
কাউন্সিল এখনও বর্তমান। তারা রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছে ও এদের আরএমপিরা বহালতবিয়ত প্র্যাকটিস
চালিয়ে যাচ্ছে।
মানসের কথামত আমিও পরীক্ষায় বসলাম। শুধুমাত্র নাম লিখে প্রায় ফাঁকা খাতা
জমা দিলাম। রেজাল্ট বের হওয়ার পর দেখলাম ৬০% মার্ক্স পেয়েছি। একটা মার্কশিটও পেলাম
হাতে। ফলে আমারো আরএমপি হওয়ার আর কোনো বাধা রইলোনা। তবু মনের মধ্যে একটা খচখচানি রয়েই
গেলো। এই ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথিতে আরএমপি হওয়ার মূল্য কতটা তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
এই রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আমার কী লাভ হবে, সেটাই ভাবতে থাকলাম।
মানসের কয়েকজন ছাত্র রেজিস্ট্রেশন পেয়ে গেল। তারা নিজেদের মত করে চেম্বার
খুলে বসে পড়ল। এদের মধ্যে একজন, ধরা যাক তার নাম তপন, তালমা হাটে একটা চেম্বার খুলে
বসল। মানস আমাকে বলল, “তপন চেম্বার খুইলা হাটে প্রাকটিস করতাসে। তুইও ওর সাথে বস গিয়া।
শিখতেও পারবি, সমাজসেবাও হবে”। আমি ভাবলাম, মন্দ কি? আমার একটা বাসনা পূর্ণ হওয়ার দিকে
একধাপ তো এগোতে পারব।
হাটের চেম্বার মানে মূলি বাঁশের দেওয়াল ঘেরা একটা ঘর। সামনের থেকে ঝাঁপ
তুলে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হয়। তার ভিতরে তপন টেবিল চেয়ার, একটা সরু খাট আর একটা আলমারি
বসিয়ে ফেলেছে। আলমারিতে ওষুধ সাজানো। তপন এখানে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করে। মানসের
কথায় তপন আমার জন্য একটা স্টেথোস্কোপ কিনে আনল শিলিগুড়ি থেকে।
আমার অবশ্য কেবলমাত্র শনিবারেই বসার সুবিধা। অন্যদিন অফিস থাকে। শনিবার
আবার হাট থাকেনা। তাই সেদিন রুগি অনেক কম আসে। কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর তপন বলল, “প্রদীপদা,
শনিবার আমি আর আসবনা, আপনি একাই চেম্বার খুলবেন”। ততদিনে আমি গ্রামের লোকদের চিনে গিয়েছি।
তারাও আমাকে চিনে গিয়েছে। দিনে দুজন কি তিনজন রুগি আসে। এক একজন এত গরিব যে পয়সা নেওয়াও
যায়না।
একদিন বিকেলের দিকে একজন রুগি এলো। বয়স ষাটের উপরে। শীর্ণ চেহারা। শ্বাস
কষ্ট হচ্ছে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। নাড়ির গতিও খুব ক্ষীন। আমি অনেক ভেবে চিন্তে
একটা ওষুধ দিয়ে লোকটাকে বসিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে শ্বাস কষ্ট কমে গেল। লোকটা আস্তে
আস্তে হেঁটে বাড়ি চলে গেল।
এর তিন চারদিন পরে মানসের চেম্বারে এসে বসেছি, এমন সময় তপন এসে ঢুকল। খুব
ক্লান্ত। আমাকে দেখতে পেয়ে তপন বলল, “আপনিও আছেন এখানে? শোনেন, আপনি গত শনিবার একটা
বুড়া লোককে ওষুধ দিসিলেন না?”
আমি বললাম, “কেন কী হয়েছে?”
তপন বলল, “লোকটা মইরা গেসে”।
আমি বললাম, “সর্বনাশ! আমার ওষুধ খেয়ে মরল নাকি?” আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত
একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
তপন বলল, “না আপনার ওষুধ খায়া ভালই ছিলো। আজকে দুপুর বেলায় নদীর ধারে বইসা
মুরগী কাটতেসিলো। এমন সময় স্ট্রোক হয়। আমি চেম্বারে ছিলাম। গিয়া দেখি, চিত হয়া পইড়া
আসে। আমি একডোজ ওষুধ মুখে ঢাইলা দিয়া তাড়াতাড়ি রাস্তার থেকে একটা গাড়ি নিয়া সোজা সদর
হাসপাতালে নিয়া আসলাম”।
আমি বললাম, “তারপর?”
“হাসপাতালেই ঘন্টা খানেক পরে শেষ। কিন্তু গ্রামের লোকেরা আমার উপর খুব খুশি।
আমি ডাক্তার হয়া নিজে রুগিকে নিয়া হাসপাতালে গেসি, তাই”।
আমার বুকের ভিতর ধরফর করতে লাগল। তপনের সাহস আছে বলেই নিজে দায়িত্ব নিয়ে
লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। তপন মানসের সাকরেদি করেছে অনেক বছর, তার উপরে বয়স অল্প।
একটা আরএমপিও আছে। আমি তো সরকারি চাকুরে, চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। সম্পূর্ণ
বে আইনিভাবে চিকিৎসা করছি। আমার কাছে লোকটার স্ট্রোক হলে আমি কী করতাম? আমি কি সঠিক
সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম? আমার ভুল হলে কী হত? আমার তো হাতে দড়ি পড়ে যেতো। এই সব ভাবতে
ভাবতে আমার রীতিমত ভয় হতে শুরু করল।
আমি ঠিক করলাম, আর না, ডাক্তারি আমার কম্ম নয়। প্রচুর রিস্ক নেওয়া হয়ে গেছে।
আর এগোলে সত্যিই বিপদে পড়তে পারি।
সেই শেষ, আমার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারির ওখানেই ইতি।
পরিশিষ্ট: হোমিওপ্যাথি কলেজের বাড়িঘর একদিন পঞ্চায়েতের দখলে চলে গেল। দেবাশীসের
পোস্ট থেকে জানলাম কলেজের বাড়িটা নাকি পুড়ে গিয়েছিল। কীভাবে আগুন লেগেছিল জানিনা। মানসের
ছাত্ররা অনেকেই অল্টারনেটিভ কাউন্সিলের আরএমপি নিয়ে ভালই প্র্যাকটিস করছে। মানস জলপাইগুড়ি
ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে এসেছিলো। বছর দশেক আগে একদিন টালিগঞ্জ ফাঁড়ির মুখে
দেখা। আমাকে ডেকে নিয়ে মিষ্টি খাওয়ালো। নিজের সংসারের অনেক গল্প শোনালো। বেশী বয়সে
দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। একটা ছেলেও আছে। সম্প্রতি গৌরাঙ্গর পোস্ট থেকে জানলাম মানস
কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে।
No comments:
Post a Comment