বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া বলে একটা কথা আছে। আমার ভাগ্যেও সেটা ঘটল। শখ ছিল লেখক হব। একেবারে বিশ্বমানের না হলেও দেশের মধ্যে একটু নাম ডাক। কিন্তু অখ্যাতির তলানিতে বসে থাকা এই আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার একটা মনের মত লেখা কোনো বিখ্যাত প্রকাশকের দরজা দিয়ে গলাতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ শিকে ছিঁড়ল। লিঙ্কডইন নামক সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ হল জন ট্যাবেরহামের সাথে। তিনি জানালেন বিখ্যাত অ্যাকাডেমিক প্রকাশক জন ওয়াইলি(John Wiley & Sons) একটা সিরিজ বার করছে যার নাম চ্যালেঞ্জেস ইন ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট। বিষয়টা কিছুটা আমার চেনা, যদিও এই বিষয়ে বই লেখার ইচ্ছে আমার কোনোকালেই ছিলনা। ইচ্ছে ছিল ছোটদের জন্য বই লিখব। কিন্তু, এবার একটু লোভ হল, ভাবলাম দিই ঠুকে একটা উত্তর। মজার কথা আমার বই লেখার প্রস্তাবটা উনি হেলায় উড়িয়ে দিলেননা। বললেন ওয়াইলির ফর্মে একটা ফর্মাল প্রস্তাব পাঠাতে। আমার সামান্য ইংরাজি বিদ্যায় যা কুলালো সেভাবেই একটা প্রস্তাব তৈরি করলাম, কিছু কথাবার্তা অন্য ওয়েবসাইট থেকেটুকে দিলাম। প্রস্তাবে লিখে দিতে হল, বইয়ের নাম কী হবে, কত পাতার বই হবে, কী কী চ্যাপটার থাকবে, কারা আমার পাঠক হতে পারেন, এ বিষয়ে আগে কোনো বই বেরিয়েছে কিনা, সেই সব বইয়ের থেকে আমার বইটি আলাদা কী তথ্য যুক্ত করবে, ইত্যাদি।
লিখে তো দিলাম। কিছুদিন পরে উত্তর এলো,
আপনি বেশ কিছু কথা অন্য ওয়েবসাইট থেকে টুকে দিয়েছেন। নিজের ভাষায় মৌলিক বক্তব্য
লিখুন। আবার নতুন করে লিখে জমা দিলাম।
এর পর উত্তর এলো, সাথে ছয় জন
রিভিউয়ারের মন্তব্য। একজন লিখেছে এনার ভাষা দূর্বল। আর একজন লিখেছে এত তথ্য একটা
বইয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, ইত্যাদি নানা বিরূপ মন্তব্য। কিন্তু একজন লিখেছেন আমি প্রদীপ
সেনগুপ্তকে চিনি, আমার স্থির বিশ্বাস তিনি একটি উৎকৃষ্ট বই লিখতে সক্ষম, এবং এই
বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট দখল আছে। জানিনা তিনি কে, অন্য কোনো প্রদীপ সেনগুপ্তের সাথে
আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন কিনা কে জানে। একজন কিছু সংশোধনের প্রস্তাব দিলেন। ওয়াইলির
সম্পাদক আমাকে একটা সংশোধিত প্রস্তাব জমা দিতে বললেন। দিলাম।
প্রায় চার মাস পরে একটা মেইল এলো।
ওয়াইলির একজন নির্বাহী সম্পাদক লিখেছেন, আমার প্রস্তাব ওয়াইলি গ্রহণ করেছে। আমাকে
আমার প্রস্তাবিত বইটি লিখতে হবে। কবে আমি পান্ডুলিপি জমা দিতে পারব তাও জানাতে
বলল। সেই সাথে বারো পাতার একটা এগ্রিমেন্ট পাঠালো, যাতে বুঝলাম সব কিছু তৈরি করে,
প্রুফ দেখে ইনডেক্স বানিয়ে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। আমার পিছনে একজন সম্পাদক লেগে
থাকবেন সব কিছু ঠিক ঠাক গাইডলাইন মত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। বইয়ে একলক্ষ চুয়ান্ন
হাজার শব্দ থাকবে, একশ পঁচিশটা লাইন
ড্রয়িং এবং পঁচিশটা ফটো থাকবে। সব আমাকেই করতে হবে। বইটির বক্তব্য আন্তর্জাতিক হতে
হবে। অন্যের কাছ থেকে কোনো ছবি অথবা টেক্সটনকল করে বইয়ে ঢোকালে মূল রচয়িতার কাছ
থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে তা সম্পাদককে পাঠাতে হবে। এগ্রিমেন্টে আমার রয়ালটির কথাও
ছিল। আমি হ্যাংলার মত
ওরা যা বলল তাই মেনে নিলাম। আমি এগারো মাস সময় চাইলাম। ১লা ডিসেম্বর ২০১৫
তারিখেএগ্রিমেন্ট সই করার একুশ দিন পরে জীবনের উনসত্তর বছর পূর্ণ করে সত্তরে পা
রাখলাম।
লিখতে শুরু করলাম। লিখতে গেলে তো
পড়তেও হবে। তাই রোজ সকালে উঠে পড়াশোনা শুরু করলাম। দেখলাম আমি যা ভেবেছি অনেকে
আমার থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে বিষয়টা ভেবেছে। আমি ক্রমেই শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকলাম।
লেখাও চলল। লেখা ম্যানেজ করার জন্য এক্সেলে একটা অ্যাপ বানিয়ে নিলাম।
সেসব তো হল। কিন্তু কেমন লিখছি জানতে
গেলে সেটা তো কাউকে পড়াতে হবে। পাঠালাম আমার বন্ধু সমরেশের কাছে। সমরেশ পড়েই বলল
তুই জঘন্য ইংরাজি লিখিস। প্রচন্ডভাবে এডিট করতে হবে। সমরেশ প্রতিদিন এসে দুঘন্টা
করে সময় দিয়ে আমার ইংরাজী কারেক্ট করতে থাকল। ওর পক্ষে ভীষণ চাপের কাজ। কিন্তু
সমরেশ ধৈর্য ধরে এগারোটা চ্যাপটার এডিট করে ভাষাটা শুদ্ধ করে দিল। এর পর তিতলি,
মানে অনন্যাকে দিলাম এডিট করার জন্য। অনন্যা ইংরাজী ভাষার ছাত্রী। তার হাতে পড়ে ভাষা
আরো একটু ঝরঝরে হয়ে উঠল।
এই ফাঁকে আমি পারমিশনগুলি জোগাড়
করলাম। দেখলাম কেউই অনুমতি দিতে কার্পন্য বোধ করে না। পান্ডুলিপি তৈরি করার সাথে
সাথে জানলাম কাকে কপিরাইট বলে, কাকে বলে পাবলিক ডমেন, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স কী
বস্তু ইত্যাদি। জানলাম কপিরাইট ক্লিয়ারেন্স সেন্টার নামক একটি সংস্থাও আছে যেখান
থেকে কপিরাইট আছে এমন লেখা বা ছবির অনুমতি নিতে হয়। রেফারেন্সের তালিকা বানানোর জন্য অ্যাপের সন্ধান
পেলাম। কুম্ভীলকবৃত্তি বা প্ল্যাগিয়ারিজম চেক করতে হয় কীভাবে তাও শিখে নিলাম। দেশ
বিদেশের ছবি, কিছু আমার তোলা- কিছু অন্যের, জোগাড় করলাম। আঁকলাম একশপঁচিশটা ছবি
অ্যাডব ইলাস্ট্রেটারে। তারপর একদিন, মানে
ডেডলাইন মেনে সবটা পাঠিয়ে দিলাম আমার এডিটরের কাছে।
এর পরের আটমাস ধরে চলল আমার আর এডিটরের
মধ্যে পত্রালাপ, পান্ডুলিপি সংশোধনের কাজ, কপি এডিটিং, বার তিনেক প্রুফ দেখা,
ইন্ডেক্স বানানো, প্রচ্ছদের জন্য ছবি জোগাড় করা ইত্যাদি। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর একটা মেইল এলো ওয়াইলির কাছ থেকে। লিখেছেন
অ্যান্ড্রু হ্যারিসন। বক্তব্য, প্রিয় প্রদীপ, আপনার বই Industrial
Water Resource Management প্রকাশিত হয়েছে। অনুগ্রহ করে আপনার বাড়ির ঠিকানা আমাকে
জানান, যেখানে আমি বইটি পাঠাবো। আপনাকে অভিনন্দন।
No comments:
Post a Comment