সম্ভবতঃ ৭২ সাল, ডিসেম্বর মাস। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা। আমরা কয়েকজন বন্ধু দল বেঁধে ঘুরতে এসেছি। থাকার ব্যবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। এক বন্ধুর দাদুর বাড়িতে একটা ঘরের মেঝেতে আমাদের সাত জনের শোয়ার ব্যবস্থা। তবে আমাদের তাতে কিছু আসে যায় না। দুপুর বেলায় এসে ইস্তক মেলায় ঘুরছি। সন্ধ্যা বেলায় দেখলাম এক জায়গায় প্যান্ডেল খাটিয়ে গানের আসর বসেছে। গিয়ে শুনলাম ঝুমুর গান হবে। স্টেজের এক পাশে ক্ল্যারিওনেট, তবলা আর হারমোনিয়াম বাজছে। কী সুন্দর মাতাল সুর। বাদকদের পাশে সাদা ধুতি, কালো কোট আর গলায় চাদর ঝুলিয়ে এক মাঝবয়সী লোক মাথা দোলাচ্ছে। আমরা মাটিতে পাতা আসনে বসে পড়লাম। একটু পরে দুটি অল্প বয়সী মেয়ে স্টেজে উঠে কোটপরা লোকটিকে প্রণাম করে এক ঘুর্ণিপাক দিয়ে স্টেজের মাঝখানে এসে গান ধরল, পরদেশী বধুঁয়া আয় রে আয় নিঝুম রাতে। নাচের তালে তালে তাদের শাড়ির আঁচল উড়ল, কোমরে হিল্লোল জাগল, আর আমরা সে গানে বুঁদ হয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে
আমি স্বপন আর প্রদীপ দে বেরিয়েছি চা খেতে। একটা চায়ের দোকানে দেখলাম দুটি জাপানী
ছেলে, চব্বিশ পচিশ বছর বয়স হবে, মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে। চা খাওয়া শেষ করে একটা বই
পড়তে শুরু করল। তারপর বইয়ের একটা পাতার এক জায়গায় আঙ্গুল রেখে একজন বাংলায় বলল এতা
কতো করে?
আমি ভাবলাম
এইদুজন বোধ হয় বাংলা জানে। তাই আমি প্রশ্ন করলাম, আপনারা কোথায় উঠেছেন?
একজন অতি
কষ্টে অনেক ভেবে বলল, নো বেনেগারু।
বুঝলাম
বাংলা জানে না। ওই বইটা দোভাষীর কাজ করে। কিন্তু ভাব হতে দেরি হলনা। দুজনেই
পড়াশোনা শেষ করে এদেশে বেড়াতে এসেছে। এখান থেকে কলকাতায় যাবে, তারপর দেশে ফিরে
যাবে। একজনের নাম নোরিও কিসিমোতো, আর এক জনের নাম কাজুমি গোজু। খুব হাসিখুসি দুজন।
একটু একটু ইংরাজি আর বাকিটা ছবি এঁকে কথা বার্তা হচ্ছিল। আমাদের তিনজনকেই উপহার
দিল কারুকাজ করা জাপানী স্কার্ফ আর জাপানী পাখা। শান্তিনিকেতনে আমার এক বন্ধুর পিশেমশাই থাকেন,
তিনি জাপানী ভাষা জানেন, কলাভবনের শিক্ষক। তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ আড্ডা
হল। জাপানী সহবতের সাথে পরিচিত হলাম। জানলাম জাপানী ভাষায় ল বর্ণটি নেই। জাপানী
জিহবা দিয়ে ল উচ্চারিত হয়না, তা সে যে ভাষায় কথা বলুকনা কেন। 'এল' উচ্চারণ করে এরু।
বিকেলে
দেখলাম এদের দুজনের সাথে আর একটি রোগা ছিপছিপে উজ্জ্বল চেহারার জাপানী ছেলে
জুটেছে। সে একটু একটু বাংলা জানে। শান্তিনিকেতনে বাংলা সাহিত্য পড়তে এসেছে। নাম
নাওকি নিসিওকা। নিসিওকা থাকায় আমাদের কথাবার্তা আরো একটু স্বচ্ছন্দ হল। সে আমাদের
মধ্যে দোভাষীর কাজ করে যাচ্ছিল।
কলকাতায়
আবার নোরিও কিসিমোতো আর কাজুমি গোজুর সাথে দেখা হল। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে
আলাপ করিয়ে দিলাম। একসাথে ঘুরলাম ঢাকুরিয়া লেক, লেকের পাশে জাপানী বৌদ্ধ মন্দির,
কালীঘাট, ক্যাওড়াতলা শ্মশান, ইত্যাদি। কলকাতার ময়দানে আমাদের ছবি তুলে দিল নোরিও।
আমাদের প্রথম রঙিন ছবি। একদিন রাত্রে বিয়ার সহযোগে ভোজ হল অ্যাম্বার রেস্টুরেন্টে।
একদিন হাজরার মোড়ে পানের দোকান থেকে মিষ্টি পান খাওয়ালাম। পান মুখে দিয়েই দুজনেই
কারাই কারাই করে চিৎকার জুড়ে দিল। জানলাম কারাই মানে ঝাল।
বেশ কয়েকদিন
পরে নোরিও এবং কাজুমির চিঠি পেলাম। সাথে বেশ কিছু ছবি। এরও বেশ কয়েক মাস পরে একটা
পিকচার পোস্টকার্ড পেলাম। একদিকে চেরি ফুলের ছবি। অন্য দিকে নাওকি নিসিওকা লিখেছে,
প্রিয় প্রদীপ, আপনি আমাকে চিনিতে পারছ কি? আমি নাওকি নিসিওকা। আপনার সাথে
শান্তিনিকেতনে আলাপ হইয়াছিল। নমস্কার। ইতি নাওকি নিসিওকা।
এদের কারো
সাথেই আর দেখা হয়নি। যোগাযোগও রাখিনি। শুধু মনে রেখে দিয়েছিলাম তখন শেখা কয়েকটা
জাপানী শব্দ, যেমন কারাই মানে ঝাল, সাকানা মানে মাছ।
অনেক বছর
পরে কলকাতা বই মেলায় দেখলাম একটা বাংলা বই। ছোট ছোট গল্প আর স্মৃতি কথা। লেখক
নাওকি নিসিওকা।
No comments:
Post a Comment