আমি আর অতনু ঠিক করলাম বক্রেশ্বর যাব। সেটা সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সাল। ঠিক করলাম দোলের দিন যাব। হাওড়া থেকে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বিকেলে নামলাম সাঁইথিয়া স্টেশনে। সেখান থেকে অন্ডাল লাইনের গাড়ি ধরব। সেদিন আর ট্রেন নেই। তাই ঠিক করলাম এখানেই কোনো হোটেলে রাত্রীবাস করব। সাঁইথিয়া স্টেশনের কাছে একটা হিন্দু হোটেল। তার উপর তলায় রাত্রীবাসের ব্যবস্থা আছে।
একটা চৌকির উপর চেপটা তোষক। তেলচিটে
বালিশ। ভাড়া দুটাকা এক রাত। তার উপরে একটা চাদর পেতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। সকাল
বেলায় গেলাম স্টেশনে। সাঁথিইয়া থেকে অন্ডালের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়ছে।
দুবরাজপুর পর্যন্ত টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। বেলা দশটা নাগাদ দুবরাজপুরে নেমে দুটো
দূঃসংবাদ শুনলাম। একটা হল, এখানে দুদিন দোল খেলা হয়। কাজেই আজকেও দোল, এবং
বিচ্ছিরি রকমের দোল। দ্বিতীয়টি হল, দোলের জন্য বক্রেশ্বর যাওয়ার বাস পাওয়া
যাবেনা। স্টেশন চত্তর থেকে দেখলাম একদল
লোক রঙ মেখে হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে। এদের হাতে পড়লে তো আর রক্ষা নেই।
রক্ষা পাওয়ার একটাই রাস্তা, কোথাও
লুকিয়ে পড়া। স্টেশনের কাছেই দেখলাম একটা বিশাল দিঘি। তার চারধার ঘিরে উঁচু বাঁধ।
ওই বাঁধের ওপারে গিয়ে লুকিয়ে থাকলে কেউ দেখতে পাবেনা এই ভেবে সোজা পুকুরের ভিতরের
দিকে চলে গেলাম। জল প্রায় দশফুট নীচে। কাজেই জলে নামতে হল না। ঢালু পাড়ে চুপচাপ
শুয়ে রইলাম একটা ঝোপের নীচে।
বেলা দুটো নাগাদ দেখলাম একজন দুজন
করে স্নান করতে ঘাটে নামছে। বুঝলাম দোল ছেড়ে গেছে। এবার যাওয়া যায়। কিন্তু যাব
কীভাবে? এখান থেকে বক্রেশ্বর এগারো কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তা ভালই। কিন্তু এতটা
হাঁটা। তার উপরের দোলের হাল্লায় মামা ভাগনে পাহাড় দেখা হলনা।পুকুর থেকে উঠে
বক্রেশ্বরের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথমে বেশ জোর কদমে। কিন্তু কিছুক্ষণ
পরেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
একটু পরে দেখি একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। বক্রেশ্বরের দিকে।
আমরা কোনোরকম পারমিশন না নিয়েই গরুর গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়োয়ান একবার পিছন ফিরে
দেখে বলল এটা বক্রেশ্বর যাবে নাই। ঝাপরতলায় নেমে যেতে হবে। তা ঝাপরতলাই সই, যতটুকু
যাওয়া যায়। ঝাপরতলায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে লোকটা বলল আর আধ কোশ যেতে হবে। হেঁটে চলে
যান।
বক্রেশ্বর পৌঁছালাম যখন, দেখলাম
সন্ধ্যা নামছে। সারাদিন প্রায় কিছুই জোটেনি। একটা দোকানে চা শিঙারা খেলাম। সেখানে দেখি এক নেড়ামাথা টিকিওলা পুরুৎ গোছের
লোক। হাত পা নেড়ে কাকে যেন কী বোঝাচ্ছে। অতনু গম্ভীরভাবে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করল। লোকটা নির্লিপ্ত ভাবে প্রণাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতনু বলল ঠাকুরমশাই আজ রাতের
মত একটা থাকার জায়গা হবে? ঠাকুরমশাই বলল, ঐ যে ধর্মশালা আছে ওখানে চলে যাও। লোক আছে, ঘর দেখিয়ে
দেবে। একটাকা নেবে। দোল পূর্ণিমার পরের রাত। সন্ধ্যার একটু পরে ধর্মশালার
পাল্লাহীন জানালা দিয়ে একরাশ চাঁদের আলো এসে ঘর ভাসিয়ে দিলো।
পরদিন ভোরে উঠে কুন্ডে গরম জলে স্নান
করলাম। হেঁটে তাঁতীপাড়ায় গেলাম বালুচরী শাড়ি বোনা দেখতে। অতনু বলল আজ রাত্রে
শান্তিনিকেতনে থাকব। ওখানে বন্ধু আছে তার কাছে থাকব। দুপুরে একটা বাস ধরে চলে এলাম শান্তিনিকেতনে।
অতনুর বন্ধুর নাম ঠিক মনে নেই।
মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরী নিয়ে শান্তিনিকেতনে পোস্টেড। দেখলাম ঘর ভর্তি বই। ঘরে একটা রেকর্ড
প্লেয়ার। পূর্বপল্লীতে যে বাড়িতে থাকে তার নাম পলাশ। শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের
বাড়ি। বাড়ির বাগানে বিশাল একটা পাথরের
পলাশ ফুল।
রাত্রে খেলাম ডিমের ওমলেট দিয়ে খিচুড়ি।
তারপর বন্ধু বলল, গান শুনবি? হিমাংশু দত্তের গানের নতুন লং প্লেয়িং রেকর্ড
বেরিয়েছে। একটা রেকর্ড চাপিয়ে দিল রেকর্ড প্লেয়ারে। বেজে উঠলপ্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কন্ঠে, "রাতের দেউলে জাগে বিরহী তারা, ওগো তন্দ্রা হারা"। একটু পরে কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার
চাঁদ উঠল গাছের মাথায়। সেই প্লাবিত জ্যোৎস্নায় সুরের মায়ায় আমরা ভাসতে থাকলাম,
চাঁদ আর চামেলীর প্রেম ও বিরহের গীতিকথায়।
No comments:
Post a Comment