Thursday, 31 December 2020
পোষাক ও ধর্ম
Saturday, 26 December 2020
বীজপত্র
(গল্প)
বৌদি আর নেই ভাবতে ভীষণ কষ্ট
হল অপর্ণার। বলল, সুবিনয়দা তো এখন নার্সিং
হোমে। বৌদির ওখান থেকে ফেরার পথে সুবিনয়দাকে একবার দেখে আসব।
সামনে হুটার লাগানো পুলিশের
গাড়ি, তারপর সুবিনয়দার মরদেহ নিয়ে গাড়ি। তারপরেই নবনীতার ড্রাইভার কায়দা করে নিজের
গাড়িটা মিছিলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। অপর্ণা তাকিয়ে দেখল কোন মন্ত্রবলে বাইপাসের
সমস্ত গাড়ি স্তব্ধ অচল হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো লাল বাতি নেই। রাস্তাড় মোড়ে মড়ে
পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি। পরমার মোড় থেকে ডানদিক ঘুরে এগিয়ে চলল শবযাত্রা। পার্ক
সার্কাসের মুখে সব গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সুবিনয়দাকে পথ ছেড়ে দেওয়ার
জন্যই।
পার্ক সার্কাস থেকে
রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত নতুন ফ্লাইওভারটা খুলে দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। অপর্ণা
এখন পর্যন্ত ওটার উপর দিয়ে যায়নি। লম্বা সেতুটার উপরে আজ একটাও গাড়ি নেই। শূণ্যের
মধ্যে লম্বা হয়ে সেতুটা শুয়ে আছে। খোলা রাস্তা পেয়ে পুলিশের গাড়ি আর সুবিনয়দার
মরদেহ নিয়ে গাড়ীটা কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার অপর প্রান্তে অপর্ণার মনে হল, এটাই
যেন সেই অনন্তের রাতা যে পথে চললে এক অবিনশ্বর আনন্দলোকে পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে হল,
এই পথে সুবিনয়দাকে নিয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে শূণ্যে মিলিয়ে যাবে।
আদম ইভের প্রত্যাবর্তন
(কল্পবিশ্ব ওয়েবজিনে প্রকাশিত )
অনীশবাবু প্রতিদিন সকাল বেলায়
লেকে বেড়াতে যান। এটা অভ্যাস করেছেন শুধু শরীরচর্চার জন্যই নয়, ওখানে গেলে বেশ
কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তারাও অনেকে তাঁরই বয়সী, সদ্য রিটেয়ার করেছে। দু একজন
অল্প বয়সীও আছে। তারাও বেশ ভালো, খুব সম্মান দেয়। যেহেতু কলেজে পড়াতেন, অনেকেই
তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করে। এই তো গত টিচার্স ডে তে একজন একটা ব্লু টুথ হেডফোন
উপহার দিয়েছে। সেটা কানে দিয়ে মোবাইল থেকে গান শোনা যায়। অনীশবাবু আজকালকার
টেকনোলজিতে ততটা অভ্যস্ত নন। নিজে কম্পিউটার চালাতে পারেননা। যা দরকার একমাত্র
মেয়ে বসুধাই করে দেয়।
বছর দুয়েক হল নতুন একজন সদস্য
জুটেছে। অবনী দত্ত। তিনি নাকি প্রবাসে ছিলেন। দুবছর হল আলিপুরে বাড়ি কিনে সেখানে স্থিতু হয়েছেন। উনি রত্ন
পাথরের ব্যবসা করে বহু টাকা উপার্জন করেছেন। ভদ্রলোককে দেখলে একটু অবাক লাগে। বয়স
কত বোঝার উপায় নেই। উনি বলেন সত্তর বছর। কিন্তু এই বয়সে চামড়া ওরকম টানটান থাকে
নাকি? বাংলা বলার সময় সম্পূর্ণ বাংলাই ব্যবহার করেন। একটু থেমে থেমে কথা বলেন, মনে
হয় অনেক ভেবে কথা বলছেন। এই দুটি বিষয় ছাড়া আর সব ব্যপারেই স্বাভাবিক। নানা বিষয়ে
জ্ঞান রাখেন। কোনো সমসা হলে চট করে সমাধান বাৎলে দিতে পারেন। আলিপুরে বাড়ি কেনা
সোজা কথা নয়। আর্থিক অবস্থা ভালো বলেই মনে হয়।
অবনী দত্তের ছেলের সাথেও আলাপ
হয়েছে। বছর ত্রিশেক বয়স হবে। সুদর্শন চেহারা। নাম পৃথু, মহাভারতের একটি চরিত্রের নামে
নাম। কথাবার্তায় চমৎকার। সে সকাল বেলায় লেকে দৌড়াতে আসে। আধঘন্টার মত দৌড়ায়। তারপর সবার সাথে কুশল বিনিময়
করে মেনকা সিনেমার উলটো দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। টানটান ঋজু চেহারা। অবনী
দত্তকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন ছেলেটি একজন বিজ্ঞানী। তবে ঠিক কোথাও চাকরী করেনা।
বাড়িতে নিজের গবেষণাগার আছে। ঘরে বসে বিভিন্ন সংস্থাকে বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ দেয়। এর
বেশি কিছু জানা যায়নি।
এই ছেলেটিকে দেখার পর থেকেই
অনীশের মাথায় একটা নতুন ভাবনা এসেছে। পৃথুকে জামাই হিসাবে বসুধার সাথে ভালো
মানাবে। কিন্তু জামাই করার ব্যাপারে কী করে যে কথাটা পারবেন এখনও ভেবে উঠতে
পারেননি।
একদিন হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল।
অবনীবাবু নিজে থেকেই অনীশবাবুকে নিমন্ত্রণ করলেন, এই রবিবার কী করছেন? আসুন না
আমার বাড়িতে সবাই মিলে, একটু চা খাবেন, বিকেলে।
চমৎকার প্রস্তাব, অনীশবাবু
লুফে নিলেন কথাটা, অবশ্যই যাব। বিকেল পাঁচটায় গেলে হবে? আমার স্ত্রী আবার ফেরেন ওই
সময়, স্কুলে পড়ান কিনা।
বেশ তো স্ত্রী আর মেয়েকেও
নিয়ে আসবেন। সবাই মিলে গল্প করা যাবে। আপনার মেয়ে তো এবার
ফিলোজফিতে এম এ পাশ করেছে, তাই না? এম ফিলে ভর্তি হয়েছে।
অনীশ একটু অবাক হলেন, এ কথাটা
অবনী দত্তের জানার কথা নয়। হয়তো অন্য কারো কাছ থেকে জেনেছে। কিন্তু এম ফিলের কথাটা
লেকের বন্ধুদের কাউকে বলেছেন বলে তো মনে পড়েনা।
আলিপুরে এমন একটা পুরোনো বাড়ি
আছে তা অনীশের ধারণাই ছিলনা। বাড়িটা শুধু পুরোনো নয়, বাড়ির আসবাবগুলিও অন্য রকম।
কোনো মিউজিয়ামে গেলে এরকম আসবাব দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ির মাঝখানে একটা চাতাল, তার
চার দিক দিয়ে ঘর। দোতলা, বেশ চওড়া সিঁড়ি। অবনী বললেন, এটা একটা জমিদার বাড়ি। আমি
কিনে নিয়েছি।
অবনীবাবুর ছেলের নাম পৃথু।
সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ছাদের উপরে চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে। দেখা গেল বাড়িতে আর
কোনো কাজের লোক নেই। পৃথুই চা, খাবার সব
নিয়ে আসছে। চমৎকার চা, খাবারও খুব ভালো। অনীশবাবুর মেয়ে বসুধার সাথেও পৃথুর আলাপ
হল। এক সময় দেখা গেল দুজনে আলাদা বসে গল্প
করছে। অনীশবাবু লক্ষ্য করলেন ছাদের উপর অনেকগুলি নানা ধরণের অ্যান্টেনা।
পৃথু বলল, কাকু, আমার কাজটা
একটু অন্য রকমের। আমি একজন অ্যাস্ট্রোবায়লজিস্ট। মহাকাশের অন্য গ্রহের প্রাণ নিয়ে
গবেষণা করি। শুধু পৃথিবীতে নয় মহাশূন্যে আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে বুদ্ধিমান
প্রাণি আছে। আমি মহাকাশের সেই সব গ্রহ থেকে আসা সঙ্কেত এখানে ধরি, সেগুলিকে
বিশ্লেষণ করি। এটাই আমার কাজ। বিশ্বে আরো অনেক সংস্থা আছে যারা এই বিষয়ে গবেষণা
করছে। আমি তাদের সাথে কাজ করি। গোপন কাজ, আশাকরি একথা আপনারা আর কাউকে জানাবেন না।
অনীশ বললেন, না না, আমি আর
কাকে বলব? আমি সাহিত্যের মানুষ, এসব বুঝিনা।
পৃথু বলল, চলুন আমার কাজের ঘর
আপনাকে দেখিয়ে আনি।
পৃথুর কাজের ঘর বলতে ঘর ভর্তি
কয়েকটা কমপিউটার, দেয়াল জুড়ে অসংখ্য আলো আর বোতাম। বাড়ির ভিতরে এরকম একটা
ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা দেখে অনীশ বেশ অবাক হলেন। বসুধাও বেশ অবাক হয়েছে। তার চোখে
মুখে একটা সম্ভ্রমের ছাপ অনীশের দৃষ্টি এড়ালো না। পৃথু ছেলেটাকে তো ভালোই মনে হল।
বসুধার সাথে বিয়ে হলে মন্দ হয় না। শুধু কী করে কথাটা পাড়বেন সেটাই সমস্যা।
কিন্তু তারও সমাধান হয়ে গেল।
পৃথু একদিন নিজে থেকেই অনীশের কাছে প্রস্তাব দিল, আমি বসুধাকে বিয়ে করতে চাই।
বসুধার এতে সম্মতি আছে।
বিয়েটা হল অবনীর বাড়িতেই। উনি
বললেন এত বড় বাড়ি, খালি পড়ে রয়েছে। বিয়ে, বৌভাত দুটোই এখানে হোক। ধুমধাম করে বিয়ে হলেও শুধুমাত্র একবস্ত্রে
মেয়েকে সম্প্রদান করতে হল। শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নেওয়া পৃথুর পছন্দ নয়। অনীশের খুব
ভালো লাগল সেটা। খুব ভালো জামাই পেয়েছেন।
বিয়ের দিন সাতেক পরে
অনীশবাবুর মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। কোথাও একটা
গোলমাল হয়েছে। বসুধা ফোন করছেনা। আজ তিন
দিন হল একবারও ফোন করেনি। একটু চিন্তিত মনে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, বসুধার ফোন
পেয়েছ?
অনীশের স্ত্রী বললেন, না তো!
দিন তিনেক হল বসুধা ফোন করেনি। আমি ভাবলাম তোমাকে বুঝি ফোন করেছে। কী হল মেয়েটার,
একদম খবর নেই।
এরকম হওয়ার কথা নয়। বিয়ের পর
থেকে বসুধা প্রতিদিন ফোনে বাবা মার খবর নেয়। অনীশবাবু খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। বসুধাকে
ফোন করলেন। ফোন থেকে যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো, এই নম্বর এখন উপলব্ধ নয়। বসুধার ফোন
খারাপ ভেবে পৃথুকে ফোন করলেন। সেখান থেকেও একই কথা ভেসে এলো। অনীশ খুব চিন্তায় পড়ে
গেলেন। কী হতে পারে? ওরা কি তবে বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে? গেলেও মা বাবাকে না
জানিয়ে যাবে কেন?
অনীশবাবু বললেন, আজ বিকেলে চল
ওদের বাড়ি যাই।
আলিপুরে অবনীর বাড়ির সামনে
দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ি অন্ধকার। সদর দরজায় তালা ঝুলছে। অনীশ মাথায় হাত দিয়ে
বসে পড়লেন। সবাই উধাও হয়ে গিয়েছে। কাউকে কিছু না বলেই। তিন জনের এভাবে চলে যাওয়া
মোটেই ভালো মনে হল না। একবার মনে হল মেয়ে দুষ্টু লোকের হাতে পড়েছে। যা দিনকাল,
লোকের ব্যবহার দেখে মতলব বোঝার উপায় নেই। কিন্তু এত টাকা পয়সা যার সে তার মেয়েকে
অপহরণ করবেই বা কেন? যে কারণেই হোক বিষয়টা গভীর দুশ্চিন্তার। এখন একমাত্র উপায়
পুলিশের কাছে যাওয়া।
সব শুনে ওসি প্রথমে খুব ধমকালেন।
আপনারা একেবারে খোঁজখবর না নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফ্রি লান্সার কনসালটিং
বিজ্ঞানী। তার উপরে অন্য গ্রহের প্রাণি নিয়ে গবেষণা। এমন কথা কেউ শুনেছে কখনও। ছবি
আছে?
অনীশ বিয়ের অ্যালবাম সাথে
করেই এনেছেন। ওসি তার থেকে দুটো ছবি খুলে রেখে দিল। বলল, কাল সকালে সার্চ ওয়ারেন্ট
নিয়ে ওই বাড়ি সার্চ করতে যাব। আপনারাও সাথে যাবেন। এখন একটা মিসিং ডাইরি করে যান।
সারা রাত দুজনেই ঘুমাতে
পারলেন না। মাঝে মাঝেই বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসছে। পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ ওসি
এসে হাজির। চলুন আপনাদের ঐ বেয়াই অবনী বাবুর অনেক খবর পেয়েছি। দু বছর আগে সাড়ে দশ
কোটি টাকায় ওরা বাড়িটা কেনে। এখানকার দুটো ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতেও বেশ
কয়েক কোটি টাকা আছে। আপনার জামাইয়ের প্যান কার্ডও আছে। তবে জালও হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল
ক্রিমিনাল হলে সবই সম্ভব। কিন্তু হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার মোটিভটা স্পষ্ট নয়।
তালা ভেঙে বাড়িটাতে ঢোকা হল।
কিন্তু একেবারে ধোয়া পোঁছা। ওই বাড়িতে যে কেউ কোনোদিন বাস করেছে তার কোনো চিহ্ন
নেই। পৃথুর ঘরের সব কমপিউটার, সুইচের প্যানেল সব উধাও। ছাদের অ্যান্টেনাগুলিও নেই।
শুধু বাড়ির মাঝখানের চাতালে একটা বিশাল গর্ত। প্রায়
কুড়ি ফুট ব্যাস। গভীর প্রায় চল্লিশ ফুট। নীচে জল জমে আছে। পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে
গিয়েছে।
ওসি বললেন, কিছুই তো বোঝা
যাচ্ছে না। বাড়ির মাঝখানে এত বড় একটা জলের কুয়ো। এরা তো
দেখছি কোনো ক্লু রেখে যায়নি। ফরেনসিককে একবার খবর দিতে হবে। আর ওই গর্তটাও একটা
রহস্য।
অনীশ বললেন, এই কুয়োটা তো আগে
ছিলোনা।
ওসি শুনে বললেন মনে হয় কিছু
দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। কুয়োর ভিতরে লোক নামিয়ে দেখা যাক। যদি ডেডবডি পাওয়া যায়।
লোক নামিয়েও কিছুই উদ্ধার
হলনা। কয়েকটা ধাতুর টুকরো আর কিছু কলকব্জা পাওয়া গেল। দেখে মনে হয় গাড়ির পার্টস। ধাতুর টুকরোগুলো নেড়েচেড়ে ওসি বললেন, এগুলি
ফরেনসিকে পাঠাতে হবে।
আরো কয়েকদিন কেটে গেল। কোনো
খোঁজ পাওয়া গেল না। মানুষগুলি যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন থানায়
খবর করা হয়েছে। কেউ এদের দেখেনি। হাসপাতাল, স্টেশন, বিমান বন্দর কোথাও না।
দীর্ঘদিন ধরে লম্বা তদন্ত
চলল। কিন্তু ফলাফল একেবারে শূন্য। পুলিশ হতাশ হয়ে দু বছর পরে ফাইল বন্ধ করে রেখে
দিল।
অনীশবাবু এই ধাক্কায় অনেকটা
ভেঙে পড়লেন। লেকে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়াও একরকম বন্ধ করে
দিলেন। এর মধ্যে একদিন স্ত্রী ও মারা গেলেন। অনীশবাবু একেবারে একা হয়ে গেলেন।
এর প্রায় দশ বছর পরে একদিন
বিকেল বেলায় শুনতে পেলেন বাইরে রাস্তার থেকে কে যেন তাকে ডাকছে অনীশ কাকু, অনীশ
কাকু বলে। একটি মেয়ের কন্ঠস্বর। জানলা দিয়ে দেখলেন একটি মেয়ে, বসুধার
বন্ধু মন্দিরা। হাতে একটা কাগজ। খুব উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলতে চাইছে। অনীশ
তাকে উপরে আসতে বললেন।
মন্দিরারর মুখ চোখ উত্তেজনায়
লাল হয়ে আছে। হাতের কাগজটা অনীশের হাতে দিয়ে বলল, বসুধার একটা ইমেইল পেয়েছি। আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা,
কিন্তু আমার মেইলে পাঠিয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কী করে এলো
তাও বুঝতে পারছিনা। আপনি পড়ে দেখুন। আমি প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছি। সাথে একটা ছবিও আছে।
বসুধা লিখেছে:
মা ও বাবা, আমি যে তোমাদের
থেকে কত দূরে আছি তা মাইল, কিলোমিটার দিয়ে বোঝাতে পারব না। শুধু আলোকবর্ষ দিয়েই তা
মাপা যায়। পৃথিবী থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে ঠিক পৃথিবীর মত একটা সবুজ নীল গ্রহে
রয়েছি। এখানে বাড়ি ঘর শহর সব কিছু আছে, অনেক রকমের প্রাণি আছে, শুধু মানুষ নেই। মানুষ
বলতে আমরা তিনজন, যদি পৃথু আর তার বাবাকে মানুষ বলা যায়। ওরা এই গ্রহের বুদ্ধিমান
প্রাণি। একেবারে মানুষের মত। ওদের সব কিছু, এমনকি ডিএনএর গঠন পর্যন্ত আমাদের মত।
কিন্তু বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে মানুষের থেকে অনেক উন্নত। এরা বহু বছর আগে এখানে এক
বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু হঠাৎ এদের মেয়েদের মধ্যে একটা জেনেটিক পরিবর্তন
আসে। ফলে মেয়েরা আর সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আস্তে আস্তে এদের জনসংখ্যা কমে
যেতে থাকে। অবশেষে তা শূন্যে নেমে যায়। তাই প্রায় তিন দশক আগে পৃথু আর তার বাবা
মহাকাশে বেরিয়ে পড়ে যদি অন্য কোনো গ্রহে তাদের মত প্রাণি থাকে তবে তাদের কোনো
নারীর সাহায্যে তাদের হারিয়ে যাওয়া সমাজ
নতুন করে তৈরি করতে পারবে।
অনেক নক্ষত্রলোক ঘুরে তারা
পৃথিবীতে এসে মানুষের সন্ধান পায়। পৃথিবীর মানুষ সব দিক দিয়ে একেবারে তাদের মত।
কলকাতায় বসে তারা খুঁজতে থাকে তাদের উপযুক্ত কনে।
তোমার মনে আছে সেই চায়ের
নিমন্ত্রণের কথা। সেদিন ওরা চায়ের কাপে লেগে থাকা আমাদের লালা পরীক্ষা করে দেখেছিল
আমাদের ম্যাচ হতে পারে কিনা। ওরা পৃথিবীর আরো অনেক মেয়েকে এই ভাবে পরীক্ষা করেছে।
কিন্তু আমাকেই ওরা সবথেকে উপযুক্ত মনে করেছে।
বাড়ির মাঝখানে একটা গর্তে
ওদের মহাকাশযান লুকানো থাকত। প্রথমে তাতে চড়ে আমরা চাঁদের কাছাকাছি এক বিশাল
আন্তর্নক্ষত্র মহাকাশযানে আসি। তারপর চার বছর ধরে আলোর গতিতে যাত্রা করে এই গ্রহে
এলাম।
ওদের এক্সপেরিমেন্ট সফল
হয়েছে। আমাদের প্রথম সন্তানের ছবি পাঠালাম, ঋদ্ধি আমার কন্যা। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে
জন্মেছে। পৃথু আর আমি এই গ্রহের নতুন আদম আর ইভ।
এখানে যান্ত্রিক ব্যবস্থা খুব
উন্নত। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থাও পৃথু করে দিয়েছে। আর
তাইতো তোমাকে এই চিঠি পাঠাতে পারছি।
বাবা, তোমার থেকে চার
আলোকবর্ষ দূরে বসে তোমার মেয়ে একটা নতুন মানব সমাজের জন্ম দিচ্ছে। এতে তোমার গর্ব
হবে না দুঃখ হবে, বুঝতে পারছিনা। চার বছর পরে তুমি এই চিঠি হাতে পাবে। পাবে কিনা তাও জানিনা।
ভালো থেকো
বাবা, মা।
অনীশবাবু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত
হয়ে বসে রইলেন। তারপর জামাকাপড় পরে তৈরি হলেন থানায় এই খবরটা জানানোর জন্য। সিঁড়ি
দিয়ে কয়েক পা নেমেই আবার উঠে এলেন। থানায় জানিয়ে কী হবে? ওরা এসব কথা
বিশ্বাসই করবে না।
মন্দিরার দিকে ফিরে বললেন,
আমার জন্য একটা কম্পিটারের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস মা? আর ই মেইল করাটাও শিখিয়ে
দিবি। এই চিঠির একটা উত্তর দিতে হবে।
(কল্পবিশ্বের লিঙ্কঃ আদম ইভের প্রত্যাবর্তন )
Saturday, 8 August 2020
আমার বিদেশী বই
বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া বলে একটা কথা আছে। আমার ভাগ্যেও সেটা ঘটল। শখ ছিল লেখক হব। একেবারে বিশ্বমানের না হলেও দেশের মধ্যে একটু নাম ডাক। কিন্তু অখ্যাতির তলানিতে বসে থাকা এই আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার একটা মনের মত লেখা কোনো বিখ্যাত প্রকাশকের দরজা দিয়ে গলাতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ শিকে ছিঁড়ল। লিঙ্কডইন নামক সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ হল জন ট্যাবেরহামের সাথে। তিনি জানালেন বিখ্যাত অ্যাকাডেমিক প্রকাশক জন ওয়াইলি(John Wiley & Sons) একটা সিরিজ বার করছে যার নাম চ্যালেঞ্জেস ইন ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট। বিষয়টা কিছুটা আমার চেনা, যদিও এই বিষয়ে বই লেখার ইচ্ছে আমার কোনোকালেই ছিলনা। ইচ্ছে ছিল ছোটদের জন্য বই লিখব। কিন্তু, এবার একটু লোভ হল, ভাবলাম দিই ঠুকে একটা উত্তর। মজার কথা আমার বই লেখার প্রস্তাবটা উনি হেলায় উড়িয়ে দিলেননা। বললেন ওয়াইলির ফর্মে একটা ফর্মাল প্রস্তাব পাঠাতে। আমার সামান্য ইংরাজি বিদ্যায় যা কুলালো সেভাবেই একটা প্রস্তাব তৈরি করলাম, কিছু কথাবার্তা অন্য ওয়েবসাইট থেকেটুকে দিলাম। প্রস্তাবে লিখে দিতে হল, বইয়ের নাম কী হবে, কত পাতার বই হবে, কী কী চ্যাপটার থাকবে, কারা আমার পাঠক হতে পারেন, এ বিষয়ে আগে কোনো বই বেরিয়েছে কিনা, সেই সব বইয়ের থেকে আমার বইটি আলাদা কী তথ্য যুক্ত করবে, ইত্যাদি।
লিখে তো দিলাম। কিছুদিন পরে উত্তর এলো,
আপনি বেশ কিছু কথা অন্য ওয়েবসাইট থেকে টুকে দিয়েছেন। নিজের ভাষায় মৌলিক বক্তব্য
লিখুন। আবার নতুন করে লিখে জমা দিলাম।
এর পর উত্তর এলো, সাথে ছয় জন
রিভিউয়ারের মন্তব্য। একজন লিখেছে এনার ভাষা দূর্বল। আর একজন লিখেছে এত তথ্য একটা
বইয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, ইত্যাদি নানা বিরূপ মন্তব্য। কিন্তু একজন লিখেছেন আমি প্রদীপ
সেনগুপ্তকে চিনি, আমার স্থির বিশ্বাস তিনি একটি উৎকৃষ্ট বই লিখতে সক্ষম, এবং এই
বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট দখল আছে। জানিনা তিনি কে, অন্য কোনো প্রদীপ সেনগুপ্তের সাথে
আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন কিনা কে জানে। একজন কিছু সংশোধনের প্রস্তাব দিলেন। ওয়াইলির
সম্পাদক আমাকে একটা সংশোধিত প্রস্তাব জমা দিতে বললেন। দিলাম।
প্রায় চার মাস পরে একটা মেইল এলো।
ওয়াইলির একজন নির্বাহী সম্পাদক লিখেছেন, আমার প্রস্তাব ওয়াইলি গ্রহণ করেছে। আমাকে
আমার প্রস্তাবিত বইটি লিখতে হবে। কবে আমি পান্ডুলিপি জমা দিতে পারব তাও জানাতে
বলল। সেই সাথে বারো পাতার একটা এগ্রিমেন্ট পাঠালো, যাতে বুঝলাম সব কিছু তৈরি করে,
প্রুফ দেখে ইনডেক্স বানিয়ে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। আমার পিছনে একজন সম্পাদক লেগে
থাকবেন সব কিছু ঠিক ঠাক গাইডলাইন মত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। বইয়ে একলক্ষ চুয়ান্ন
হাজার শব্দ থাকবে, একশ পঁচিশটা লাইন
ড্রয়িং এবং পঁচিশটা ফটো থাকবে। সব আমাকেই করতে হবে। বইটির বক্তব্য আন্তর্জাতিক হতে
হবে। অন্যের কাছ থেকে কোনো ছবি অথবা টেক্সটনকল করে বইয়ে ঢোকালে মূল রচয়িতার কাছ
থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে তা সম্পাদককে পাঠাতে হবে। এগ্রিমেন্টে আমার রয়ালটির কথাও
ছিল। আমি হ্যাংলার মত
ওরা যা বলল তাই মেনে নিলাম। আমি এগারো মাস সময় চাইলাম। ১লা ডিসেম্বর ২০১৫
তারিখেএগ্রিমেন্ট সই করার একুশ দিন পরে জীবনের উনসত্তর বছর পূর্ণ করে সত্তরে পা
রাখলাম।
লিখতে শুরু করলাম। লিখতে গেলে তো
পড়তেও হবে। তাই রোজ সকালে উঠে পড়াশোনা শুরু করলাম। দেখলাম আমি যা ভেবেছি অনেকে
আমার থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে বিষয়টা ভেবেছে। আমি ক্রমেই শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকলাম।
লেখাও চলল। লেখা ম্যানেজ করার জন্য এক্সেলে একটা অ্যাপ বানিয়ে নিলাম।
সেসব তো হল। কিন্তু কেমন লিখছি জানতে
গেলে সেটা তো কাউকে পড়াতে হবে। পাঠালাম আমার বন্ধু সমরেশের কাছে। সমরেশ পড়েই বলল
তুই জঘন্য ইংরাজি লিখিস। প্রচন্ডভাবে এডিট করতে হবে। সমরেশ প্রতিদিন এসে দুঘন্টা
করে সময় দিয়ে আমার ইংরাজী কারেক্ট করতে থাকল। ওর পক্ষে ভীষণ চাপের কাজ। কিন্তু
সমরেশ ধৈর্য ধরে এগারোটা চ্যাপটার এডিট করে ভাষাটা শুদ্ধ করে দিল। এর পর তিতলি,
মানে অনন্যাকে দিলাম এডিট করার জন্য। অনন্যা ইংরাজী ভাষার ছাত্রী। তার হাতে পড়ে ভাষা
আরো একটু ঝরঝরে হয়ে উঠল।
এই ফাঁকে আমি পারমিশনগুলি জোগাড়
করলাম। দেখলাম কেউই অনুমতি দিতে কার্পন্য বোধ করে না। পান্ডুলিপি তৈরি করার সাথে
সাথে জানলাম কাকে কপিরাইট বলে, কাকে বলে পাবলিক ডমেন, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স কী
বস্তু ইত্যাদি। জানলাম কপিরাইট ক্লিয়ারেন্স সেন্টার নামক একটি সংস্থাও আছে যেখান
থেকে কপিরাইট আছে এমন লেখা বা ছবির অনুমতি নিতে হয়। রেফারেন্সের তালিকা বানানোর জন্য অ্যাপের সন্ধান
পেলাম। কুম্ভীলকবৃত্তি বা প্ল্যাগিয়ারিজম চেক করতে হয় কীভাবে তাও শিখে নিলাম। দেশ
বিদেশের ছবি, কিছু আমার তোলা- কিছু অন্যের, জোগাড় করলাম। আঁকলাম একশপঁচিশটা ছবি
অ্যাডব ইলাস্ট্রেটারে। তারপর একদিন, মানে
ডেডলাইন মেনে সবটা পাঠিয়ে দিলাম আমার এডিটরের কাছে।
এর পরের আটমাস ধরে চলল আমার আর এডিটরের
মধ্যে পত্রালাপ, পান্ডুলিপি সংশোধনের কাজ, কপি এডিটিং, বার তিনেক প্রুফ দেখা,
ইন্ডেক্স বানানো, প্রচ্ছদের জন্য ছবি জোগাড় করা ইত্যাদি। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর একটা মেইল এলো ওয়াইলির কাছ থেকে। লিখেছেন
অ্যান্ড্রু হ্যারিসন। বক্তব্য, প্রিয় প্রদীপ, আপনার বই Industrial
Water Resource Management প্রকাশিত হয়েছে। অনুগ্রহ করে আপনার বাড়ির ঠিকানা আমাকে
জানান, যেখানে আমি বইটি পাঠাবো। আপনাকে অভিনন্দন।
চাঁদ ও চামেলী
আমি আর অতনু ঠিক করলাম বক্রেশ্বর যাব। সেটা সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সাল। ঠিক করলাম দোলের দিন যাব। হাওড়া থেকে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বিকেলে নামলাম সাঁইথিয়া স্টেশনে। সেখান থেকে অন্ডাল লাইনের গাড়ি ধরব। সেদিন আর ট্রেন নেই। তাই ঠিক করলাম এখানেই কোনো হোটেলে রাত্রীবাস করব। সাঁইথিয়া স্টেশনের কাছে একটা হিন্দু হোটেল। তার উপর তলায় রাত্রীবাসের ব্যবস্থা আছে।
একটা চৌকির উপর চেপটা তোষক। তেলচিটে
বালিশ। ভাড়া দুটাকা এক রাত। তার উপরে একটা চাদর পেতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। সকাল
বেলায় গেলাম স্টেশনে। সাঁথিইয়া থেকে অন্ডালের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়ছে।
দুবরাজপুর পর্যন্ত টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। বেলা দশটা নাগাদ দুবরাজপুরে নেমে দুটো
দূঃসংবাদ শুনলাম। একটা হল, এখানে দুদিন দোল খেলা হয়। কাজেই আজকেও দোল, এবং
বিচ্ছিরি রকমের দোল। দ্বিতীয়টি হল, দোলের জন্য বক্রেশ্বর যাওয়ার বাস পাওয়া
যাবেনা। স্টেশন চত্তর থেকে দেখলাম একদল
লোক রঙ মেখে হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে। এদের হাতে পড়লে তো আর রক্ষা নেই।
রক্ষা পাওয়ার একটাই রাস্তা, কোথাও
লুকিয়ে পড়া। স্টেশনের কাছেই দেখলাম একটা বিশাল দিঘি। তার চারধার ঘিরে উঁচু বাঁধ।
ওই বাঁধের ওপারে গিয়ে লুকিয়ে থাকলে কেউ দেখতে পাবেনা এই ভেবে সোজা পুকুরের ভিতরের
দিকে চলে গেলাম। জল প্রায় দশফুট নীচে। কাজেই জলে নামতে হল না। ঢালু পাড়ে চুপচাপ
শুয়ে রইলাম একটা ঝোপের নীচে।
বেলা দুটো নাগাদ দেখলাম একজন দুজন
করে স্নান করতে ঘাটে নামছে। বুঝলাম দোল ছেড়ে গেছে। এবার যাওয়া যায়। কিন্তু যাব
কীভাবে? এখান থেকে বক্রেশ্বর এগারো কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তা ভালই। কিন্তু এতটা
হাঁটা। তার উপরের দোলের হাল্লায় মামা ভাগনে পাহাড় দেখা হলনা।পুকুর থেকে উঠে
বক্রেশ্বরের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথমে বেশ জোর কদমে। কিন্তু কিছুক্ষণ
পরেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
একটু পরে দেখি একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। বক্রেশ্বরের দিকে।
আমরা কোনোরকম পারমিশন না নিয়েই গরুর গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়োয়ান একবার পিছন ফিরে
দেখে বলল এটা বক্রেশ্বর যাবে নাই। ঝাপরতলায় নেমে যেতে হবে। তা ঝাপরতলাই সই, যতটুকু
যাওয়া যায়। ঝাপরতলায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে লোকটা বলল আর আধ কোশ যেতে হবে। হেঁটে চলে
যান।
বক্রেশ্বর পৌঁছালাম যখন, দেখলাম
সন্ধ্যা নামছে। সারাদিন প্রায় কিছুই জোটেনি। একটা দোকানে চা শিঙারা খেলাম। সেখানে দেখি এক নেড়ামাথা টিকিওলা পুরুৎ গোছের
লোক। হাত পা নেড়ে কাকে যেন কী বোঝাচ্ছে। অতনু গম্ভীরভাবে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করল। লোকটা নির্লিপ্ত ভাবে প্রণাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতনু বলল ঠাকুরমশাই আজ রাতের
মত একটা থাকার জায়গা হবে? ঠাকুরমশাই বলল, ঐ যে ধর্মশালা আছে ওখানে চলে যাও। লোক আছে, ঘর দেখিয়ে
দেবে। একটাকা নেবে। দোল পূর্ণিমার পরের রাত। সন্ধ্যার একটু পরে ধর্মশালার
পাল্লাহীন জানালা দিয়ে একরাশ চাঁদের আলো এসে ঘর ভাসিয়ে দিলো।
পরদিন ভোরে উঠে কুন্ডে গরম জলে স্নান
করলাম। হেঁটে তাঁতীপাড়ায় গেলাম বালুচরী শাড়ি বোনা দেখতে। অতনু বলল আজ রাত্রে
শান্তিনিকেতনে থাকব। ওখানে বন্ধু আছে তার কাছে থাকব। দুপুরে একটা বাস ধরে চলে এলাম শান্তিনিকেতনে।
অতনুর বন্ধুর নাম ঠিক মনে নেই।
মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরী নিয়ে শান্তিনিকেতনে পোস্টেড। দেখলাম ঘর ভর্তি বই। ঘরে একটা রেকর্ড
প্লেয়ার। পূর্বপল্লীতে যে বাড়িতে থাকে তার নাম পলাশ। শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের
বাড়ি। বাড়ির বাগানে বিশাল একটা পাথরের
পলাশ ফুল।
রাত্রে খেলাম ডিমের ওমলেট দিয়ে খিচুড়ি।
তারপর বন্ধু বলল, গান শুনবি? হিমাংশু দত্তের গানের নতুন লং প্লেয়িং রেকর্ড
বেরিয়েছে। একটা রেকর্ড চাপিয়ে দিল রেকর্ড প্লেয়ারে। বেজে উঠলপ্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কন্ঠে, "রাতের দেউলে জাগে বিরহী তারা, ওগো তন্দ্রা হারা"। একটু পরে কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার
চাঁদ উঠল গাছের মাথায়। সেই প্লাবিত জ্যোৎস্নায় সুরের মায়ায় আমরা ভাসতে থাকলাম,
চাঁদ আর চামেলীর প্রেম ও বিরহের গীতিকথায়।
আমার জাপানী বন্ধুরা
সম্ভবতঃ ৭২ সাল, ডিসেম্বর মাস। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা। আমরা কয়েকজন বন্ধু দল বেঁধে ঘুরতে এসেছি। থাকার ব্যবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। এক বন্ধুর দাদুর বাড়িতে একটা ঘরের মেঝেতে আমাদের সাত জনের শোয়ার ব্যবস্থা। তবে আমাদের তাতে কিছু আসে যায় না। দুপুর বেলায় এসে ইস্তক মেলায় ঘুরছি। সন্ধ্যা বেলায় দেখলাম এক জায়গায় প্যান্ডেল খাটিয়ে গানের আসর বসেছে। গিয়ে শুনলাম ঝুমুর গান হবে। স্টেজের এক পাশে ক্ল্যারিওনেট, তবলা আর হারমোনিয়াম বাজছে। কী সুন্দর মাতাল সুর। বাদকদের পাশে সাদা ধুতি, কালো কোট আর গলায় চাদর ঝুলিয়ে এক মাঝবয়সী লোক মাথা দোলাচ্ছে। আমরা মাটিতে পাতা আসনে বসে পড়লাম। একটু পরে দুটি অল্প বয়সী মেয়ে স্টেজে উঠে কোটপরা লোকটিকে প্রণাম করে এক ঘুর্ণিপাক দিয়ে স্টেজের মাঝখানে এসে গান ধরল, পরদেশী বধুঁয়া আয় রে আয় নিঝুম রাতে। নাচের তালে তালে তাদের শাড়ির আঁচল উড়ল, কোমরে হিল্লোল জাগল, আর আমরা সে গানে বুঁদ হয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে
আমি স্বপন আর প্রদীপ দে বেরিয়েছি চা খেতে। একটা চায়ের দোকানে দেখলাম দুটি জাপানী
ছেলে, চব্বিশ পচিশ বছর বয়স হবে, মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে। চা খাওয়া শেষ করে একটা বই
পড়তে শুরু করল। তারপর বইয়ের একটা পাতার এক জায়গায় আঙ্গুল রেখে একজন বাংলায় বলল এতা
কতো করে?
আমি ভাবলাম
এইদুজন বোধ হয় বাংলা জানে। তাই আমি প্রশ্ন করলাম, আপনারা কোথায় উঠেছেন?
একজন অতি
কষ্টে অনেক ভেবে বলল, নো বেনেগারু।
বুঝলাম
বাংলা জানে না। ওই বইটা দোভাষীর কাজ করে। কিন্তু ভাব হতে দেরি হলনা। দুজনেই
পড়াশোনা শেষ করে এদেশে বেড়াতে এসেছে। এখান থেকে কলকাতায় যাবে, তারপর দেশে ফিরে
যাবে। একজনের নাম নোরিও কিসিমোতো, আর এক জনের নাম কাজুমি গোজু। খুব হাসিখুসি দুজন।
একটু একটু ইংরাজি আর বাকিটা ছবি এঁকে কথা বার্তা হচ্ছিল। আমাদের তিনজনকেই উপহার
দিল কারুকাজ করা জাপানী স্কার্ফ আর জাপানী পাখা। শান্তিনিকেতনে আমার এক বন্ধুর পিশেমশাই থাকেন,
তিনি জাপানী ভাষা জানেন, কলাভবনের শিক্ষক। তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ আড্ডা
হল। জাপানী সহবতের সাথে পরিচিত হলাম। জানলাম জাপানী ভাষায় ল বর্ণটি নেই। জাপানী
জিহবা দিয়ে ল উচ্চারিত হয়না, তা সে যে ভাষায় কথা বলুকনা কেন। 'এল' উচ্চারণ করে এরু।
বিকেলে
দেখলাম এদের দুজনের সাথে আর একটি রোগা ছিপছিপে উজ্জ্বল চেহারার জাপানী ছেলে
জুটেছে। সে একটু একটু বাংলা জানে। শান্তিনিকেতনে বাংলা সাহিত্য পড়তে এসেছে। নাম
নাওকি নিসিওকা। নিসিওকা থাকায় আমাদের কথাবার্তা আরো একটু স্বচ্ছন্দ হল। সে আমাদের
মধ্যে দোভাষীর কাজ করে যাচ্ছিল।
কলকাতায়
আবার নোরিও কিসিমোতো আর কাজুমি গোজুর সাথে দেখা হল। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে
আলাপ করিয়ে দিলাম। একসাথে ঘুরলাম ঢাকুরিয়া লেক, লেকের পাশে জাপানী বৌদ্ধ মন্দির,
কালীঘাট, ক্যাওড়াতলা শ্মশান, ইত্যাদি। কলকাতার ময়দানে আমাদের ছবি তুলে দিল নোরিও।
আমাদের প্রথম রঙিন ছবি। একদিন রাত্রে বিয়ার সহযোগে ভোজ হল অ্যাম্বার রেস্টুরেন্টে।
একদিন হাজরার মোড়ে পানের দোকান থেকে মিষ্টি পান খাওয়ালাম। পান মুখে দিয়েই দুজনেই
কারাই কারাই করে চিৎকার জুড়ে দিল। জানলাম কারাই মানে ঝাল।
বেশ কয়েকদিন
পরে নোরিও এবং কাজুমির চিঠি পেলাম। সাথে বেশ কিছু ছবি। এরও বেশ কয়েক মাস পরে একটা
পিকচার পোস্টকার্ড পেলাম। একদিকে চেরি ফুলের ছবি। অন্য দিকে নাওকি নিসিওকা লিখেছে,
প্রিয় প্রদীপ, আপনি আমাকে চিনিতে পারছ কি? আমি নাওকি নিসিওকা। আপনার সাথে
শান্তিনিকেতনে আলাপ হইয়াছিল। নমস্কার। ইতি নাওকি নিসিওকা।
এদের কারো
সাথেই আর দেখা হয়নি। যোগাযোগও রাখিনি। শুধু মনে রেখে দিয়েছিলাম তখন শেখা কয়েকটা
জাপানী শব্দ, যেমন কারাই মানে ঝাল, সাকানা মানে মাছ।
অনেক বছর
পরে কলকাতা বই মেলায় দেখলাম একটা বাংলা বই। ছোট ছোট গল্প আর স্মৃতি কথা। লেখক
নাওকি নিসিওকা।
মুক্তমেলা, তুষার রায় ও ডাক্তারবাবু
মুক্তমেলা ছিল সৃষ্টিশীল কলকাতার এক অনন্য আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছিল এবং কিছুদিন পরে কিছু গুন্ডার হস্তক্ষেপে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতি শনিবার এক অমোঘ আকর্ষণে বিকেল বেলায় মুক্তমেলায় হাজির হতাম। গিয়ে দেখতাম
কোনো এক শিল্পী গাছের ডালে তাঁর নতুন শিল্পকর্মগুলি সাজাচ্ছেন। কেউ গান গাইছে,
কেউবা আবৃত্তি করছে। এদের মধ্যে যাঁরা একটু অন্যরকম তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি
তুষার রায়। তাঁকে ঘিরে থাকা শ্রোতাদের ভীড়ে মধ্যমণি হয়ে কবিতা বলছেন। এমন সময় হয়তো
কোনো মাউন্টেড পুলিশ একটু উঁকি দিয়েছে। কবি বলে উঠলেন:
“পুলিশ ওরে পুলিশ
হাতে কী তোর, কুলিশ?
কবির কাছে আসিস যদি
টুপিটা তোর খুলিস”
কেউ অনুরোধ করলেই ওনার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ব্যান্ডমাস্টার বলতে শুরু করে
দিতেন, তাঁর অসামান্য নিজস্ব ভঙ্গিতে:
“আমি অঙ্ক কষতে পারি ম্যাজিক
লুকিয়ে চক ও ডাস্টার
কেননা ভারী ধুন্ধুমার ট্রাম্পেটবাদক
ব্যান্ডমাস্টার”
কবি তুষার রায় ছিলেন মুক্তমেলার
মুকুটহীন সম্রাট। তিনি যেখানেই দাঁড়াতেন তাকে ঘিরে একটা ভীড় জমে যেত। অসামান্য
বাচনভঙ্গী আর বেপরোয়া ভাষার জন্য।
পরবর্তিকালে চৌরঙ্গীর এক চায়ের দোকানে তাঁর সাথে আড্ডা দিয়েছি। সে অন্য এক
গল্প।
একজনের কথা মনে আছে, নাম মনে নেই। তিনি
না দেখে বাংলা ভাষার এক দীর্ঘ কবিতা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের লেখা মধুবংশীগলি
অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন।
একটু সন্ধ্যার দিকে আসতেন ডাক্তারবাবু।
তিনি আসতেন ধান্যকুড়িয়া থেকে। এসেই মাটিতে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতেন:
“ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায় সকাল ছটায়
গাড়ি
নিতুই ছোটা ছুটি কারণ স্টেশনের কাছে বাড়ি
আমি ডেইলি প্যাসেঞ্জার...”
গান শেষ হতেই সবাই আরো গান শুনতে চাইতো। তখন হয়তো “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে”
এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে গেয়ে উঠতেন:
“মোর প্রেয়সীর মান হইয়েছে, গুমরে কেঁদে মোলো
ওই কাঁদুনি গিন্নী তোমার বন্ধ করাই ভালো”
ডাক্তারবাবুর নাম যশোদাদুলাল মন্ডল। পুরোনো কলকাতার গল্পে এঁর একটা স্থায়ী আসন
থাকা উচিত। কারণ কলকাতার এক মর্মস্পর্শী অধ্যায় তাঁর গানে ধরা আছে। অদ্ভুত এক
ছন্দে গাওয়া গানটি হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে বেরিয়েছিল এবং অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।
শুনেছি ওটি নাকি প্ল্যাটিনাম ডিস্কও হয়েছিলো। গানটি হল:
“ক্যালকাটা নাইনটিন ফর্টিথ্রি অক্টোবর.......”
বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের মন্বন্তর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কলকাতার দৃশ্য
আঁকা আছে সেই গানে। কারো কি মনে পড়ছে সেই গানটা?
হোমিওপ্যাথি
প্রথমেই বলে রাখি, যদিও এটি সত্যি ঘটনা তবুও কোথাও কোথাও স্মৃতি আমার সাথে
চাতুরী করে থাকতে পারে। তবে এই কাহিনির পাত্রপাত্রীরা অনেকেই সশরীর বর্তমান। ভুলভ্রান্তি
তাঁরাই শুধরে দেবেন।
হোমিওপ্যাথিতে আমার আগ্রহ অনেক দিনের। ছোটবেলা থেকে হেঁপোরুগি বলে নানা
রকম চিকিৎসার সাথে সাথে হোমিওপ্যাথি ওষুধও খেতে হয়েছে বিস্তর। তার উপরে ডাক্তার হওয়ার
শখও ছিল। মেডিকাল কলেজে পড়ার সুযোগ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে অনেকদিনই। ভাবলাম একটু বই
টই পড়ে হোমিওপ্যাথি শিখে রাখব। আখেরে কাজেও লাগতে পারে। বাহাত্তর সাল নাগাদ ডাক্তার
হওয়ার একটা সুযোগ এলো।
তখন এমএসসি পাশ করে বেকার বসে আছি। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে গিয়ে রিসার্চের
নামে আড্ডা মারি। সেই সময় এক ভূতাত্বিক দাদা কলেজে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্লাইড জিওলজি
পড়তে এলো। দাদার বয়স তখন ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে। বিবাহিত। সেই দাদাকে দেখলাম নামের আগে
ডক্টর লিখছে। আর একদিন দেখলাম কলেজের একটি মেয়েকে পাশে বসিয়ে প্যাড খুলে খসখস করে প্রেস্ক্রিপশন
লিখছে। আমি তো অবাক। দাদা আমাকে পাশে বসিয়ে বলল, “আমি একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। দরকার
হলে বোলো”।
বললাম, “তুমি ডাক্তারি পড়লে কবে? আর ডাক্তার হলেই বা কবে?”
দাদা বলল, “আমি ডাক্তারি পড়িনি। আমি আরএমপি মানে রেজিস্টার্ড মেডিকাল প্র্যাকটিশনার।একটা
চান্স পেলাম, নিয়ে নিয়েছি। হোমিওপ্যাথি মেডিকাল কাউন্সিল একটা নিয়ম করেছে, যারা পাশ
না করেও অনেকদিন ধরে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করছে তাদেরকে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দিচ্ছে।
তার জন্য অবশ্য কিছু নিয়ম কানুন আছে, কয়েকজন ডাক্তারের রেকমেন্ডেশন চাই, প্র্যাকটিসের
প্রমাণ চাই, ইত্যাদি। আমি সেসব জোগাড় করে অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিলাম। আমার রেজিস্ট্রেশন
হয়ে গেছে। তুমি চাইলে তোমারটাও করিয়ে দিতে পারি”।
আমি বললাম, “কী করে?”
দাদা বলল, “সে আমি ব্যবস্থা করে দেবো”।
আমি দাদার সাথে কয়েকদিন নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করলাম। কাউন্সিলেও গেলাম।
কিন্তু হলনা। আসলে বয়সটাই সমস্যা হল। দশ বছর প্র্যাকটিস করেছি এটা প্রমাণ করতে পারলামনা।
কারণ দশ বছর আগে আমি নিতান্তই নাবালক ছিলাম। কাউন্সিল ঐ স্কিমটা সাময়িকভাবে চালু করেছিলো।
পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সেবারের মত ডাক্তার হওয়া হলনা।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। ১৯৮৪ সালে চাকরী সূত্রে বদলী হয়ে এলাম জলপাইগুড়িতে।
জলপাইগুড়িতে সময় কাটানোর জন্য সন্ধ্যাবেলায় বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে বসতাম। পাঠাগারের
পাশেই একদিন দেখলাম এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার। গিয়ে দেখি আমার স্কুলের বন্ধু
মানস সেখানে বসে প্র্যাকটিস করছে। ভালোই হল, আমার একটা আড্ডা মারার জায়গা হল। মানস
অবশ্য কোয়াক প্র্যাকটিস করা “আরএমপি” নয়। রীতিমত পাশ করা ডাক্তার। জলপাইগুড়িতে ছাড়াও
শিলিগুড়িতে চেম্বার আছে। কোট-টাই পরে প্র্যাকটিস করে।
একদিন মানস আমাকে বলল, “জলপাইগুড়িতে একটা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ খুলসি। চল তোকে দেখাতে নিয়া যাব”।
জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়ায় বৌবাজারের পাশে বিরাট একটা মাঠ ছিল। সেখানে অনেকটা
জায়গা নিয়ে হোমিওপ্যাথি কলেজের বাড়ি উঠেছে। বাংলা প্যাটার্ণের বাড়ি। লম্বা টানা বারান্দা।
হাসপাতালের ওয়ার্ড, ক্লাস রুম, অফিস, সব কিছু নিয়ে খুব ছিমছাম চেহারা। সবুজ রঙের টিনের
চাল, দেয়ালের অর্ধেক সিমেন্টের গাঁথনি, বাকিটা বেড়ার দেওয়াল। দুটো ওয়ার্ডে গোটা কুড়ি
বেড, আবার একটা শিশুদের ওয়ার্ডও আছে। গোটা তিনেক ক্লাসরুম, ল্যাবরেটারি সবই তৈরি হয়েছে।
সব মিলিয়ে অনেকটা সেনাবাহিনীর ফিল্ড অফিসের মত দেখতে। মানস খুব খাতির করে আমাকে প্রিন্সিপালের
চেম্বারে নিয়ে বসালো।
মানসের সাথে সাথে কয়েকজন ছেলেও এসে ঢুকল চেম্বারে। মানস আমার সাথে আলাপ
করিয়ে দিল। এরা সবাই মেডিকাল এর ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ারের । মানস বলল, “বুঝলি উত্তরবঙ্গে
এইটাই প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেডিকাল কলেজ হবে। আমি একটা কমিটি করসি। তাতে সরকারি আমলা
থেকে এমএলএ, এমপিদেরকেও রাখসি। টাকা পয়সা ভালই উঠতাসে। অভাব হবেনা”।
আমার ভালই লাগল। আমাদের একজন বন্ধু এত বড় একটা কাজ হাতে নিয়েছে। আমি মনে
মনে বেশ একটু ইনভলভড হয়ে গেলাম। এইভাবে দিন কাটে। সন্ধ্যা বেলায় মানসের চেম্বারে গিয়ে
বসি। মানসের ছাত্ররাও দু একজন এসে বসে। মানস তাদের সাথে রোগের উপসর্গ, ওষুধ, পোটেন্সি,
এসব নিয়ে আলোচনা করে। এসব দেখতে দেখতে আমার ডাক্তার হওয়ার বাসনাটা আবার চাগিয়ে উঠল।
একদিন মানসকে বলেই ফেললাম, “দ্যাখ আমি যদি তোর কলেজে ভর্তি হই তা হলে কেমন
হয়? আমাকে অবশ্য অফিস থেকে পারমিশন নিতে হবে। তা সে আমি জোগাড় করে নেবো”।
মানস বলল, “তুই তো ভালই চাকরি করতাসিস। আবার ছাত্র হবি ক্যান। তুই বরং ফ্যাকাল্টি
হয়ে যা”।
শুনে তো আমি হাঁ। “ফ্যালাল্টি হব কিরে? আমি ডাক্তারির কি জানি? মেটিরিয়া
মেডিকা একটু নাড়াচাড়া করেছি। তার বেশি তো কিছু জানিনা”।
মানস বলল, “তুই তো জিওলজি পড়সিস, তাতে বায়োলজি পড়তে হয়না?”
আমি বললাম, “হয়, কিন্তু সে তো প্যালিওবায়োলজি। ফসিলের ব্যাপার”।
মানস বলল, “ওতেই হবে, তোকে একটা ফিজিওলজি বই দিতাসি। পড়ে নিস। তুই পড়াবি”।
বইটা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। নিরস বই। মানসের অনুরোধে সত্যিই একদিন ক্লাস
নিলাম। ক্লাস নিয়েই বুঝলাম এটা আমার কাজ না। তবে ছাত্ররাও দেখলাম খুব ভালো। একটাও প্রশ্ন
করলনা।
এর মধ্যে কলেজের প্যাথোলজি ল্যাবের কিছু যন্ত্রপাতি এসে গেল। সকালে ওপিডি
চালু হয়ে গেল। পান্ডাপাড়া কলোনি, ও আশেপাশের গ্রাম থেকে রুগিও আসতে শুরু করল। সকাল
বেলায় মানস এবং আরো দুজন ডাক্তার এসে ওপিডি সামলায়। ছাত্ররা ওপিডিতে বসে রেপার্টারি
বানায়। দু তিনজন ছাত্রের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। এর মধ্যে জলপাইগুড়ি সায়েন্স ক্লাবের
সাথে খুব জড়িয়ে পড়লাম। এই হোমিওপ্যাথির দু একজন ছাত্রও আমাদের ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়ে
পড়ল।
একদিন মানস বলল, “কলেজের সাথে একটা ব্লাড ব্যাঙ্ক খুলতে হবে। তার জন্য টাকা
চাই। চাঁদা তুলতে হবে। পুরো উত্তরবংগ ঘুরে স্কুলে স্কুলে চাঁদা তুলব। তুইও সাথে চল”।
আমি বললাম “আমার এমাসে ফিল্ডওয়ার্ক আছে। এই সাথে আমি ফিল্ডওয়ার্কটাও সেরে
নেবো। আমার সাথে ঘুরলে তোদের খরচ কিছুটা বেঁচে যাবে”।
কয়েকদিন ধরে মানস ও তার দুজন ছাত্রকে নিয়ে জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলার নানা
জায়গা ঘুরলাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে চাঁদা তুলে দিলো। ঘুরে এসে দেখলাম হাজার পাঁচেক টাকা
জমা হয়েছে। মানস বলল, এতে হবেনা, আরো কয়েক জায়গায় ড্রাইভ দিতে হবে।
কলেজের কাজকর্ম ভালই এগোচ্ছিলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো কলেজের এফিলিয়েশন
নিয়ে। এফিলিয়েশন না হলে কলেজের কোনো দাম নেই। ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে পারবেনা। ডিগ্রিও
পাবেনা। হোমিওপাথি কাউন্সিলের কাছে আগেই আবেদন জমা দেওয়া হয়েছিলো। মানস কলকাতায় গিয়ে
নিয়মিত তদবির চালাচ্ছিল। অবশেষে শোনা গেল কলকাতা থেকে একটা টিম কলেজ পরিদর্শনে আসবে।
পরিদর্শনের কয়েকদিন আগে থেকে মানস হাসপাতালে কয়েকজন রুগি ভর্তি করে নিলো।
কয়েকজন ডাক্তারকেও রাজি করালো ওদিন হাজির থাকার জন্য। দু একজন সরকারি অফিসার, পঞ্চায়েতের
সদস্য, এদেরকেও হাজির থাকতে বলল। আমিও আমন্ত্রিত হলাম। কলকাতা থেকে কাউন্সিলের তিনজন
প্রতিনিধি এলেন। বেশ রাশভারি লোকজন। আমার সাথেও তাঁরা আলাপ করলেন।
দুতিন দিন তাঁরা জলপাইগুড়িতে থেকে, বেড়িয়ে টেড়িয়ে ফিরে গেলেন। আমাদের সংগ্রহ
করা ব্লাডব্যাংকের টাকা খরচ হয়ে গেলো। কিন্তু কলেজটা কাউন্সিলের অ্যাফিলিয়েশন পেলো
না। এর মধ্যে বছর ঘুরে গেছে। জনা কুড়ি ছাত্র দু বছর ধরে মাইনে দিচ্ছে। হয়তো ক্যপিটেশন
ফিও দিয়েছে। এসব এতদিন চলেছে স্রেফ মানসের গুডউইলে। এবার আসল সমস্যা শুরু হল।
ছাত্ররা দেখল তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এখানে পড়ে থেকে লাভ নেই। আবার ছেড়ে
যেতেও পারছেনা। অনেক টাকা দিয়ে ফেলেছে। তখন সবাই মানসকে ধরে পড়ল কিছু একটা বিহিত করার
জন্য। এটা জলপাইগুড়ি না হয়ে অন্য শহর হলে এতদিনে কলেজে আগুন ধরিয়ে দিতো। জলপাইগুড়ির
মানুষরা একটু ঢিলাঢালা গোছের হওয়াতে পরিস্থিতি ভায়োলেন্ট হলনা। এদিকে মানস নিজেও খুব
চিন্তায় পড়ে গেল। এতগুলি ছেলেকে আশা দিয়ে তাদেরকে নিরাশ করে সে নিজেও হাত ধুয়ে ফেলতে
চাইলনা।
সে সময় দেশজুড়ে একটা বিশেষ প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তা হল সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন
করে মেডিকাল কাউন্সিল গঠন করা। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি
বা আয়ুর্বেদ ইউনানি ছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে।
সেগুলি আমাদের দেশে স্বীকৃত নয়। কিন্তু সেই সব চিকিৎসা পদ্ধতির লিটারেচার আছে, সম্ভবতঃ
গবেষণা পত্রও প্রকাশিত হয়। কিছু বুদ্ধিমান মানুষ সেগুলির উপর ভিত্তি করে একটা করে বিকল্প
চিকিৎসা পদ্ধতির কাউন্সিল বানিয়ে ফেলল। এগুলি সব সোসাইটির অ্যাক্টে রেজিস্টার্ড এবং
এদের মেমোরান্ডামে চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার একটা ক্লজ ঢোকানো আছে। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে,
বিহারে, মধ্যপ্রদেশে, আসামে এক একটি কাউন্সিল গজিয়ে উঠল। উদাহরণ হিসাবে এই চিকিৎসা
ব্যবস্থাগুলির নাম বলছি: ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথি, ব্যাচ ফ্লাওয়ার রেমিডি, ইত্যাদি।
মানস দেখল এই কাউন্সিলগুলির মাধ্যমে যদি এই ছাত্রদের আরএমপি দেওয়ার ব্যবস্থা
করা যায় তা হলে আপাততঃ এই শঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে। মানস ছাত্রদের জানিয়ে দিল যে তারা
যদি এই বিকল্প চিকিৎসায় আরএমপি হতে চায় তাহলে মানস তার ব্যবস্থা করে দেবে। এটা পেলে
তারা আইনসঙ্গতভাবেই চিকিৎসা করতে পারবে, কিন্তু রুগিকে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে
পারবেনা। ছাত্ররা দেখল এটা মন্দের ভালো। চিকিৎসা করে উপার্জন করতে পারলেই হল।
দেখা গেল বেশ কিছু ছাত্র এতে রাজি। মানস এই ছাত্রদের স্বার্থে নিজে ইলেক্ট্রো
হোমিওপ্যাথি শিখে এই পদ্ধতিতেই চিকিৎসা শুরু করল। একই সাথে নিজের চেম্বারে ছাত্রদের
ক্লাস নিতে শুরু করল। অজানা ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথিতে রুগিদের আগ্রহ হওয়ার কথা নয়। তাই
মানস নিজেই রোগিদের কাছে গিয়ে হানা দিতে শুরু করল এবং চিকিৎসা করতে শুরু করল। দু একটি
ক্ষেত্রে সফলতাও পেলো।
এইভাবে কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পরে মানস ঘোষণা করল, “অল্টারনেটিভ কাউন্সিল
পরীক্ষা নিতে রাজি হয়েছে”। এই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলে সবাই আরএমপি পেয়ে যাবে। তা হলে
নিজের নিজের চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করতে পারবে। মানস আমাকে বলল, “তুইও পরীক্ষায় বস
গিয়া যা”। (ক্রমশঃ)
আমার খুব সন্দেহ ছিল যে এই সব কাউন্সিলের আরএমপি কতটা আইনসম্মত। মানস আমাকে
বোঝালো এগুলি নাকি সংবিধানের ১৯ নম্বর ও ২১ নম্বর আর্টিকেল সম্মত। এই সব কাউন্সিলের
বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে কেস হয়েছে। কিন্তু মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট একটা স্টে
অর্ডার দিয়েছে। ফলে এরা নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি এই সব
কাউন্সিল এখনও বর্তমান। তারা রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছে ও এদের আরএমপিরা বহালতবিয়ত প্র্যাকটিস
চালিয়ে যাচ্ছে।
মানসের কথামত আমিও পরীক্ষায় বসলাম। শুধুমাত্র নাম লিখে প্রায় ফাঁকা খাতা
জমা দিলাম। রেজাল্ট বের হওয়ার পর দেখলাম ৬০% মার্ক্স পেয়েছি। একটা মার্কশিটও পেলাম
হাতে। ফলে আমারো আরএমপি হওয়ার আর কোনো বাধা রইলোনা। তবু মনের মধ্যে একটা খচখচানি রয়েই
গেলো। এই ইলেক্ট্রো হোমিওপ্যাথিতে আরএমপি হওয়ার মূল্য কতটা তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
এই রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আমার কী লাভ হবে, সেটাই ভাবতে থাকলাম।
মানসের কয়েকজন ছাত্র রেজিস্ট্রেশন পেয়ে গেল। তারা নিজেদের মত করে চেম্বার
খুলে বসে পড়ল। এদের মধ্যে একজন, ধরা যাক তার নাম তপন, তালমা হাটে একটা চেম্বার খুলে
বসল। মানস আমাকে বলল, “তপন চেম্বার খুইলা হাটে প্রাকটিস করতাসে। তুইও ওর সাথে বস গিয়া।
শিখতেও পারবি, সমাজসেবাও হবে”। আমি ভাবলাম, মন্দ কি? আমার একটা বাসনা পূর্ণ হওয়ার দিকে
একধাপ তো এগোতে পারব।
হাটের চেম্বার মানে মূলি বাঁশের দেওয়াল ঘেরা একটা ঘর। সামনের থেকে ঝাঁপ
তুলে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হয়। তার ভিতরে তপন টেবিল চেয়ার, একটা সরু খাট আর একটা আলমারি
বসিয়ে ফেলেছে। আলমারিতে ওষুধ সাজানো। তপন এখানে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করে। মানসের
কথায় তপন আমার জন্য একটা স্টেথোস্কোপ কিনে আনল শিলিগুড়ি থেকে।
আমার অবশ্য কেবলমাত্র শনিবারেই বসার সুবিধা। অন্যদিন অফিস থাকে। শনিবার
আবার হাট থাকেনা। তাই সেদিন রুগি অনেক কম আসে। কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর তপন বলল, “প্রদীপদা,
শনিবার আমি আর আসবনা, আপনি একাই চেম্বার খুলবেন”। ততদিনে আমি গ্রামের লোকদের চিনে গিয়েছি।
তারাও আমাকে চিনে গিয়েছে। দিনে দুজন কি তিনজন রুগি আসে। এক একজন এত গরিব যে পয়সা নেওয়াও
যায়না।
একদিন বিকেলের দিকে একজন রুগি এলো। বয়স ষাটের উপরে। শীর্ণ চেহারা। শ্বাস
কষ্ট হচ্ছে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। নাড়ির গতিও খুব ক্ষীন। আমি অনেক ভেবে চিন্তে
একটা ওষুধ দিয়ে লোকটাকে বসিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে শ্বাস কষ্ট কমে গেল। লোকটা আস্তে
আস্তে হেঁটে বাড়ি চলে গেল।
এর তিন চারদিন পরে মানসের চেম্বারে এসে বসেছি, এমন সময় তপন এসে ঢুকল। খুব
ক্লান্ত। আমাকে দেখতে পেয়ে তপন বলল, “আপনিও আছেন এখানে? শোনেন, আপনি গত শনিবার একটা
বুড়া লোককে ওষুধ দিসিলেন না?”
আমি বললাম, “কেন কী হয়েছে?”
তপন বলল, “লোকটা মইরা গেসে”।
আমি বললাম, “সর্বনাশ! আমার ওষুধ খেয়ে মরল নাকি?” আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত
একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
তপন বলল, “না আপনার ওষুধ খায়া ভালই ছিলো। আজকে দুপুর বেলায় নদীর ধারে বইসা
মুরগী কাটতেসিলো। এমন সময় স্ট্রোক হয়। আমি চেম্বারে ছিলাম। গিয়া দেখি, চিত হয়া পইড়া
আসে। আমি একডোজ ওষুধ মুখে ঢাইলা দিয়া তাড়াতাড়ি রাস্তার থেকে একটা গাড়ি নিয়া সোজা সদর
হাসপাতালে নিয়া আসলাম”।
আমি বললাম, “তারপর?”
“হাসপাতালেই ঘন্টা খানেক পরে শেষ। কিন্তু গ্রামের লোকেরা আমার উপর খুব খুশি।
আমি ডাক্তার হয়া নিজে রুগিকে নিয়া হাসপাতালে গেসি, তাই”।
আমার বুকের ভিতর ধরফর করতে লাগল। তপনের সাহস আছে বলেই নিজে দায়িত্ব নিয়ে
লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। তপন মানসের সাকরেদি করেছে অনেক বছর, তার উপরে বয়স অল্প।
একটা আরএমপিও আছে। আমি তো সরকারি চাকুরে, চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। সম্পূর্ণ
বে আইনিভাবে চিকিৎসা করছি। আমার কাছে লোকটার স্ট্রোক হলে আমি কী করতাম? আমি কি সঠিক
সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম? আমার ভুল হলে কী হত? আমার তো হাতে দড়ি পড়ে যেতো। এই সব ভাবতে
ভাবতে আমার রীতিমত ভয় হতে শুরু করল।
আমি ঠিক করলাম, আর না, ডাক্তারি আমার কম্ম নয়। প্রচুর রিস্ক নেওয়া হয়ে গেছে।
আর এগোলে সত্যিই বিপদে পড়তে পারি।
সেই শেষ, আমার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারির ওখানেই ইতি।
পরিশিষ্ট: হোমিওপ্যাথি কলেজের বাড়িঘর একদিন পঞ্চায়েতের দখলে চলে গেল। দেবাশীসের
পোস্ট থেকে জানলাম কলেজের বাড়িটা নাকি পুড়ে গিয়েছিল। কীভাবে আগুন লেগেছিল জানিনা। মানসের
ছাত্ররা অনেকেই অল্টারনেটিভ কাউন্সিলের আরএমপি নিয়ে ভালই প্র্যাকটিস করছে। মানস জলপাইগুড়ি
ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে এসেছিলো। বছর দশেক আগে একদিন টালিগঞ্জ ফাঁড়ির মুখে
দেখা। আমাকে ডেকে নিয়ে মিষ্টি খাওয়ালো। নিজের সংসারের অনেক গল্প শোনালো। বেশী বয়সে
দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। একটা ছেলেও আছে। সম্প্রতি গৌরাঙ্গর পোস্ট থেকে জানলাম মানস
কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে।